বৌদ্ধ জং ‘বাঘের ডেরা’
সেই কবে একবার ঢাকা বেড়াতে গিয়েছিলাম international passport নিয়ে। ভেবেছিলাম, আবার বিদেশ যাচ্ছি passport, visa সবই লাগবে — উফ্!! সে কী রোমাঞ্চ, কিন্তু … যদিও অন্য দেশ, তবুও ভুটান যেতে ভারতীয়দের সে ভাবে কোনও সরকারি কাগজের প্রয়োজন হয়না, লাগে ‘এন্ট্রি পারমিট’।
ভুটানের সীমান্তবর্তী ফুন্টশোলিং-এর যে ফটকে ‘Welcome to Bhutan’ লেখা, তার রংবাহারি নকশা সারা দেশ জুড়ে। সাধারণ মানুষের বাড়ি মনে হয় রামধনুর খেলা। কাঠের তৈরি বসত বাড়িগুলির গায়ে খুব সূক্ষ্ন কাজ যার মূল ব্যবহৃত রং লাল, সবুজ, সোনালী, হলুদ। কিছু বাড়ির গায়ে ছোট করে বুদ্ধমূর্তি আকা আবার কিছু বাড়িতে বৌদ্ধধর্মের মূল জপমন্ত্র ‘ওম মণিপদ্মে হুম’-এর অক্ষর অঙ্কন করা।
ভুটান রাজশাসিত দেশ আর এখানে রাজাদেশ পালিত হয় অক্ষরে অক্ষরে। বর্তমান রাজা জিগ্মে সিংহে ওয়াংচুক্ দেশ শাসন করছেন ১৯৭২ সাল থেকে। ভুটানের যে কোনও ছোট বড় রেস্তোরা, দোকান, এমনকী বাড়িতেও রাজার ছবি দেখতে পাওয়া যায়— তবে তা তার যৌবনকালের। এ যুগেও এমন রাজভক্ত দেশ— ভাবা যায়না!!
রাজা ওয়াংচুকের রাজেত্ব কোনও রকম ধূমপানের নেশা দণ্ডনীয় অপরাধ। একটি সময়ে সেখানকার কলেজের ছাত্র- ছাত্রীরা dendrite জাতীয় আঠা মাদক দ্রব্যের মত সেবন করত, তাই সারা দেশে এই জিনিসও পাওয়া যায় না। আমাদের সঙ্গের নেশাড়ুরা তাই জয়গা থেকে প্যাকেট প্যাকেট সিগারেট কিনে নিয়েছিল। আর যখনই কোনও check post-এ গাড়ি দাড়িয়েছে সব প্যাকেট লুকোনো হয়েছে সেই ছোট্ট শিশুটির ব্যাগের ভিতর। ধরা পড়লে জরিমানা তো হতই, রাজাদেশে কারাদণ্ডও হতে পারত। কী সাংঘাতিক দেশ রে বাবা! আবার অন্য দিকে মদ্যপানের উপর কোনও কড়াকড়ি নেই। এখানে আলাদা করে মদ্যপানের জায়গাও (bar) নেই। যে কোন হোটেল-রেস্তোরায় গেলেই চোখে পড়েছে সারি সারি বিলিতি মদের বোতল। এখানকার স্থানীয় বিয়ারকে ‘চ্যাং’ বলে। পাহাড়ি রাস্তায় চলাকালীন যে সব ছোট ধাবায় জলখাবারের জন্য থেমেছি, সর্বত্রই এক দৃশ্য। পথচলতি লোকজন দোকানে ঢুকছে। এক-দু গেলাস বিয়ার জলের মতন গলায় ঢালছে। পয়সা দিচ্ছে। চলে যাচ্ছে। আগে বললাম ‘সাংঘাতিক দেশ’?— এখন বলছি ‘অদ্ভুত’।
আপাত শান্ত দেশজুড়ে ‘রয়্যাল ভুটান আর্মি’-র অতন্দ্র প্রহরা। সঙ্গে ভারতীয় সেনারাও আছে। আমাদের দেশ থেকে অনেক ধরনের সাহায্য পায় ভুটান সরকার। তাই বোধহয় ভারতীয়দের প্রতি আতিথেয়তা একটু বেশি। আমাদের এই ধারণা আরোও জোরালো হয়েছিল পারোর মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে। সেখানে টিকিট কাটার সময় একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ে। লেখা, অন্যদের তুলনায় ভারতীয়দের টিকিট মূল্য কম লাগবে।
ভুটানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বাদ দিয়ে যা আমাকে সব থেকে আকর্ষণ করেছে তা এখানকার বৌদ্ধধর্ম। এই ধর্মাবলম্বী দেশ নেপাল আর আমাদের দেশের সিকিমও। কিন্তু এখানকার সঙ্গে পার্থক্য হল মহাযান সম্প্রদায়ের তন্ত্রসাধনার যোগ। কিংবদিন্ত অনুযায়ী, এ েদশে তন্ত্রসাধনার প্রবর্তন হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মগুরু পদ্মসম্ভবের আর্বিভাবের পরে, যিনি এখানে গুরু রিনপোশ নামে পরিচিত। ইনি এক উড়ন্ত বাঘিনীর পিঠে চড়ে এসে এক পর্বত গুহায় প্রায় তিন মাস ধ্যান করেন। পরবর্তিকালে এই স্থানেই গড়ে ওঠে তাক্সাং (Taktsang) জং। এই স্থানটি পারো শহর থেকে প্রায় ৩ ঘন্টার পথ। খাড়া পাহাড়ের ওপরে (১০,৩০২ ফুট)। তাক্সাং শব্দটির অর্থ হল “বাঘের ডেরা”। গুরু রিনপোশের এ দেশে আসার কারণ ছিল সেই দুষ্ট ড্রাগনদের দমন করা, যারা এখানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে বাধার সৃিষ্ট করছিল। পরবর্তি সময়ে অবশ্য এই ড্রাগনই হয়ে ওঠে এ দেশের রক্ষক। ড্রাগনের কথা যখন উঠলই, তখন বলে রাখি যে পুরাতন কালে এ দেশকে “ড্রুক ইয়ুল” (Land of Thunder Dragon) বলা হত। অবশ্য সংস্কৃত ভাষানুসারে ভুটান শব্দটির উৎপত্তি “ভু-উত্থান” থেকে যার অর্থ উচু ভূমি।
গুরু রিনপোশের পরে আরও অনেক ধর্মগুরু এ দেশে বৌদ্ধধর্মের প্রচার চালিয়েছেন। সমগ্র দেশ জুড়ে— পাহাড়ের আনাচে কানাচে, জনবসতি স্থলে— চোখে পড়ে ছোট-বড় সুন্দর মিন্দর। এগুলোকে আসলে “ছোড়তেন” বলা হয়— ধর্মগুরুদের সমাধিস্থল। সারা দেশে আরোও একটি লক্ষ্যণীয় বস্তু হল “দাশি”। এগুলো এক ধরনের সরু সরু রঙিন পতাকা। দূর থেকে দেখতে রামধনুর মত। কাছে গেলে বোঝা যায় তাতে মন্ত্র লেখা। জনমত বলে, এই ধর্মীয় পতাকা স্বর্গের সঙ্গে যোগ স্থাপনের উপায়।
ফেরার দিন সকলে ফুন্টশোলিং থেকে সপিং করে এপারে আসার পথে সেই ‘welcome’ লেখা ফটকের একটু আগে চোখে পড়েছিল এবারকার ভুটান যাত্রার শেষ জং। মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় ফিরে তো সেই গতেবাধা অফিস, সংসার— ধুর্!! আরও একটা কারণ ছিল মন খারাপের। ভুটানের সর্বত্র তুষার ভালুকের মত ফুলো ফুলো সারমেয়। এই জীবটি আমার খুবই প্রিয়। কিছু প্রজাতি এতই লোমশ যে তাদের শুধু নাকটুকুই দেখা যায়। যদিও কলকাতার বাড়িতে দুটি বিদ্যমান, তবুও লোভ সামলাতে পারিনি। একটিকে প্রায় নিয়ে ফেলেছিলাম— চুরি করেই। কিন্তু বাকিদের অত্যন্ত আপত্তি থাকায় আনা হয়নি। আজও মাঝে মাঝে মনে হয় ছোট্ট স্নুপির কথা।