এক ছুটে ভুটান
ভুটান, হঠাৎই যাওয়ার সুযোগ হয়ে গেল। সাড়ে আটজনের একটা দল। ‘সাড়ে’ বলতে দেড় বছরের এক জ্যান্ত পুতুল, আমাদের বন্ধুদম্পতির কন্যাসন্তান।
শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে চড়ে সোজা এন জে পি। সেখান থেকে গাড়িতে আলিপুরদুয়ারে এক বাগানবাড়িতে রাত কাটিয়ে পরের দিন দুপুর বারোটা নাগাদ আমাদের যাত্রা শুরু ভুটানের উদ্দেশে। সীমান্তবর্তী ছোট শহর জয়গাতে গাড়ি বদল করে শেষ মুহূর্তের কেনাকাটা সেরে একটি টাটা সুমোয় নিজেদের আর লটবহর ভর্তি করে মহা আনেন্দ সমস্বরে গেয়ে উঠি যাত্রা শুরুর গান, ‘আমাদের যাত্রা হল শুরু… মিয়াও মিয়াও মিয়াও’। যদিও শুরুটা কবিগুরুর, শেষের তিনটি শব্দ আমার একটি সফ্ট টয়ের আওয়াজ। কোনও এক অবচেতন মুহূর্তে গানটি গুনগুন করার সময় খেলনা বেড়ালটি ডেকে উঠেছিল। সেই শুরু।
জয়গাঁ থেকে যখন রওনা হলাম, তখন প্রায় বিকেল চারটে। সেন্ধ নামতে কিছু বাকি। রাস্তা ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে উঠে গেছে। দু’দিকে চা বাগান, তবে তা এক দেড় কিলোমিটারের বেশি নয়। তার পরেই পাহাড়ি গাছালি। পাহাড়ে অন্ধকার নামে হঠাৎই। তাতে আবার কুয়াশা। তাই যাওয়ার পথে প্রকৃতির শোভা কিছুই টের পাইনি। টানা সাড়ে ছ ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে সাতটা পাহাড় ডিঙিয়ে, রাত দশটা (ভারতীয় সময়) নাগাদ, সেলিম ভাই (আমাদের টাটা সুমোর চালক) আমাদের পৌছে দিলেন থিম্পু শহরের হোটেল “ড্রাগন রুট”-এ। সেলিম ভাই গত আট বছর ধরে ভুটানে পর্যটক নিয়ে যাচ্ছেন। সে দেশের ভাষা, জংখা (Dzongkha), বলেন মাতৃভাষার মত। আমাদের সাত দিনের ছোট ভ্রমণকাহিনীর একজন অন্যতম চরিত্র হয়ে থাকবেন তিনি। ভুটান সম্পর্কে অনেক তথ্য তার মুখেই শোনা। আর গাড়ি চালানো!! সে কিছু বলার নেই।
একেবেকে যেতে যেতে একসময় হঠাৎই পাহাড়ের গায়ে দূরে ভেসে উঠেছিল শত শত উজ্জ্বল দীপশিখার আলো আর সেগুলো যতই কাছে আসতে লাগল বুঝলাম এ দেশের রাজধানী, থিম্পুও কাছে আসছে। পাহাড় কেটে এত সুন্দর, সাজানো, পরিপাটি শহর দেখে মন ভরে গেল। তবে এ কিছুই নয়। পরদিন সকালে সোনা ঝলমল রোদে বেরিয়ে দেখলাম আমাদের হোটেলের চারধারে শুধুই পাহাড়। সম্পূর্ণ শহর বলতে যা বোঝায়, তার সব উপকরণই আছে এই রাজধানী শহরে: স্কুল, কলেজ, প্রশাসনিক দফতর, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, চিড়িয়াখানা (যদিও নির্মীয়মান)। ভুটান রাজশাসিত দেশ। রাজপ্রাসাদ তো থাকবেই।
হাতে সময় সবারই খুব কম, তাই সকাল সকাল পাশের একটি সস্তার রেেস্তারায় প্রাতরাশ সেরে শহর ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। ভেবেছিলাম তিব্বতি খাবার ছাড়া অন্য কিছু পেতে সমস্যা হবে। কিন্তু মেনুকার্ডে আলুর পরোটা দেখে সবাই “ভোট ফর আলুর পরোটা” করল।
প্রথমেই গেলাম রাজপ্রাসাদ দেখতে। বিশাল জায়গা জুড়ে দেশের শাসন ব্যবস্থার সমস্ত দফতর আর তার মাঝে প্রাসাদ। রাজপরিবার অন্যত্র থাকে। প্রাসাদ এখন দর্শনীয় স্থান, কিন্তু সরকারি গাইড সঙ্গে না থাকলে প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই চত্বরের একদিক দিয়ে বয়ে গেছে পাহাড়ি নদী যার অপর পারে সার্ক (SAARC) সম্মেলন ভবন। ভবনের নিরাপত্তা এতই কঠোর যে এপার থেকে ছবি তুলতে হলেও অনুমতি নিতে হয়। তা ছাড়া, প্রাসাদের গায়ে সারিবদ্ধ গাছের ফাক দিয়ে সে ভবন দেখতেও পাওয়া যায় না। ৯০% দেশবাসী জাতীয় পোশাক পরেন: ছেলেরা ‘ঘো’ আর মেয়েরা ‘কিরা’। প্রশাসনিক কার্যালয়েও এর কোন ব্যতিক্রম নেই।
সেখান থেকে বেরিয়ে শহরের মধ্যেই ঘুরতে ঘুরতে দেখা হল থিম্পুর সব থেকে বড় স্কুল। বাজার অঞ্চল ছাড়িয়ে আরও অনেকটা উচ্চতায় গেলাম বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র দেখতে। মোহিতাং চিড়িয়াখানায় কেবল কয়েকটি ‘টাকিন’ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কতকটা আমাদের পরিচিত ইয়াকের মত দেখতে, এটি ভুটানের জাতীয় পশু। কিন্তু মানুষ দেখলে বড্ড লজ্জা পায় বোধ হয়। তাই অনেক দূরে গাছের আড়াল থেকে আমাদের দর্শন দিয়েছিল। দুঃখ রয়ে গেল যে, তাদের ক্যামেরাবিন্দ করতে পারলাম না। ঘুরতে ঘুরতে তারপর গেলাম চানজাংতা জং। দেশের ধর্মীয় স্থান যাকে আমরা ‘গুম্ফা’ বলি। ভুটান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশ। এখানে দেখলাম একটা নতুন জিনিস। সারা দেওয়াল জুড়ে ‘জপযন্ত্র’। এর একটি ঘোরানো মানে সব কটি ঘোরাতে হবে। তবেই নাকি মুক্তি!
ভুটানের সব চেয়ে পুরনো জং হল পুনাখায়। পরের দিন তাই রওনা হলাম পুনাখার উেদ্দশে। পুনাখা ছিল এ দেশের প্রথম রাজধানী। থিম্পুর তুলনায় অনেকটাই নেমে পুনাখার রাস্তা। এখানে পৌছলাম প্রায় চার ঘন্টায়। যে রিসর্টে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল তার কাটাতারের বেড়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে েস্রাতিস্বনী পাহাড়ি নদী। মালপত্র হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে জমা রেখে বেরিয়ে পড়লাম সেই প্রাচীন জংটি দেখতে। দুই নদী, ফো-ছুু আর মো-ছুুর সঙ্গমস্থলে অবিস্থত এই জং। নদীর উপর দিয়ে ঝুলন্ত িব্রজ পার হয়ে প্রবেশ করলাম জং চত্বরে। এত শান্ত পরিবেশ যে পাতা পড়ার শব্দ পাওয়া যায়। দূর থেকে ভেসে আসছিল সুর করে মন্ত্রপাঠের সমস্বর। এখানে শুধু পুজো হয় না, এটা আশ্রমও বটে আবার একই সঙ্গে গুরুকুলও। পাথর আর কাঠ দিয়ে তৈরি এই জং স্থাপত্য শিেল্পর এক অদ্ভুত উদাহরণ। উচু প্রাচীর বেিষ্টত জংটি অনেকগুলো ভবনে বিভক্ত, কতকটা আমাদের রামকৃষ্ণ মিশনের মতো। তার কোনওটিতে থাকেন শিক্ষকেরা, কোনওটিতে ছাত্ররা, কোনওটি অর্চনার জন্য ব্যবহৃত, আবার কোনটিতে হয় প্রতিদিনের পঠনপাঠন। এ সবের মধ্যবর্তী যে ভবন সেটি সব থেকে সুসজ্জিত এবং আকারেও বড়। কাঠের খাড়া সিড়ি বেয়ে প্রায় দোতলার সমান উঠে একটি ছোট চাতাল, সামনে লোহার দরজা। দরজার পাশে সুবৃহৎ জপযন্ত্র। আকার যাই হোক, মুক্তির লোভে তাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এতটাই মসৃণ করে দেওয়া হয়েছে যে শিশুরাও অনায়াসেই তা ঘোরাতে পারছিল। দরজা দিয়ে ঢুকে দেখলাম আবার দু সারি কাঠের সিড়ি দু’দিকে উঠে গেছে। পাশে আরও অনেক দরজা। ততক্ষণে আমাদের সঙ্গী হয়েছে জং-এর এক তরুণ লামা। ভাঙা ভাঙা ইংরেজি আর হিিন্দ মিশিয়ে আমাদের বোঝাল, এইসব দরজার অন্য পাশে আছে নানান রূপের বুদ্ধমূর্তি। এক এক করে আটটি দেখলাম। একেকটি মূর্তি প্রায় কুড়ি ফুট উচু। মূর্তির সামনে ছোট-বড় নানান মাপের ঘি ভর্তি প্রদীপ। কেউ জ্বালাতে চাইলেই জ্বালাতে পারে। আর দক্ষিণা দিলেই কমণ্ডলুতে রাখা কর্পূর জল হাতে ঢেলে দিচ্ছিল সেই লামা। ভাগ্যে সে সঙ্গে ছিল। না হলে বোধহয় এখনও সেই জং-এর সিড়ি আর দরজার গোলকধাধায় ঘুরে বেড়াতে হত। মনে পড়ে গিয়েছিল ফেলুদার গেল্পর (যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে) গুম্ফার কথা।
প্রধান গুম্ফা থেকে বেরিয়ে ঢুকলাম আর একটিতে। সেখানে সবে পুজো শেষ হয়েছে। কিছু বিদেশি তরুণ খাতা কলম নিয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রধান লামার কথা শুনছিল। বুঝলাম তারা বৌদ্ধধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করছে। কিছুক্ষণের জন্য দলে ভিড়ে গেলাম, এই ফাঁকে যদি কিছু জানা যায়। কিন্তু হল না। তাদের সঙ্গে যে গাইড ছিল, সে-ই বাধ সাধল— আগে টাকা দিয়ে তাকে “book” করতে হবে। বিনি পয়সায় জ্ঞান অর্জন!!
এখানে অবশ্য একটা ভারী মজার জিনিস চোখে পড়ল। বুদ্ধমূর্তির সামনে ভোগ হিসেবে রাখা খাদ্যসামগ্রী— চাল, ডাল, ফল (এ সব তো হিন্দু দেবদেবীদেরও খাদ্য)— তার সঙ্গে ডিম (সেদ্ধ না কাঁচা বোঝার উপায় নেই), বিস্কুটের প্যাকেট আর চকোলেট (প্রায় তুলে নিয়েছিলাম)!! জং থেকে যখন বেরোলাম তখন প্রায় সেন্ধ। ফেরত এলাম রিসর্টে।
এখানে বলে রাখি, এই রিসর্ট ভুটান রাজের শ্বশুরমশাইয়ের। বলাই বাহুল্য, তার শ্বশুরালয় এই পুনাখাতেই। একই পরিবারের চার বোনকে বিয়ে করেছেন তিনি। ওখানের নিয়মানুযায়ী, এক পরিবারের দুই জামাতার সামাজিক মর্যাদা সমান হওয়া চাই। কিন্তু দেশে রাজা তো একটাই হয়। তাই রাজার চার রানি।
থিম্পু থেকে পুনাখা যেতে পথে একটি মনোরম স্থান হল “দো চোলা পাস” (dor chula), যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে Operation Flush-out 2003-এর নিহত সৈনিকদের সমাধিক্ষেত্র। এক একটি স্তেম্ভর গায়ে অসাধারণ রংবাহারি শিল্পকর্ম। এই জায়গা থেকে এভারেস্ট শিখর দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম কারণ আকাশ সেদিন ছিল যথেষ্ট পরিষ্কার। সেলিম ভাইয়ের কথায়, আট বছরে এই প্রথম এই স্থান থেকে এত স্পষ্ট এভারেস্ট-দর্শন হয় তার।
পরদিন সকালে রওনা হলাম পারোর দিকে। থিম্পুর আগে এই শহরই ছিল ভুটানের রাজধানী। শহরের মধ্যে চলাফেরা করলে মনে হয় না পাহাড়ি দেশ। সমতল ভূমির মত রাস্তা। শ্রীনগর ভ্যালির মত। এ শহরকে বলা যায় “Queen of Bhutan”। বিকেলবেলায় পৌছে শুধুমাত্র একটি জং আর আশপাশ ঘুরে ফিরে গিয়েছিলাম আমাদের মনোরম হোটেল সামদেনচোলিং-এ।
পরদিন সকালে প্রথমেই যাওয়া হল মিউজিয়াম দেখতে। গম্বুজাকৃতি এই স্থাপত্যটিকে বাইরে থেকে দেখে সবাই নিিশ্চত ছিলাম যে, আধ ঘন্টার মধ্যে সব দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু পাক্কা দুটি ঘন্টা কোথা দিয়ে কেটে গেল, বোঝানো মুশকিল। পাথর কেটে বানানো গম্বুজটির ভেতরের দেওয়াল, সিড়ি, তাক— সমস্ত কাঠের। যারা কলকাতার শহিদ মিনার বা দিিল্লর কুতুব মিনারে উঠেছে, তারা জানে যে মিনারের মধ্যে সিড়ি কী ভাবে ঘুরে ঘুরে উপর দিকে উঠে গেছে। কিন্তু সেখানে কেবলই সিড়ি। আর এই গম্বুজের ভেতর তো এ দেশের ইতিহাস সাজানো!! কী নেই সেখানে: স্টাফ করা পশুপাখি, কীট-পতঙ্গ, প্রাগৈতিহাসিক যুগের আসবাব, বাসন, অস্ত্র। বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের কথা, সেখানের রাজবংশের ইতিকথা— সমস্ত কিছু। এখানেই প্রথম Three Dimensional ডাকটিকিট দেখলাম।
পারো শহরেই ভুটানের একমাত্র বিমানবন্দর। যার বিবরণ দিতে গেলে এক কথায় বলা যায় “পিকচার পোস্টকার্ড”। যতদুর নজর যায়, শুধুই পাহাড়— সবুজ, রুক্ষ, ঘোলাটে নীল আর একদম দূরে, প্রায় আকাশের কাছে, তুষারাবৃত পর্বতশিখর। বিমানবন্দরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পারো ছু নদী। বিমানবন্দরের দফতরগুলির রং গাঢ় সবুজ আর সাদা আর প্রশস্ত রানওয়ে সম্পূর্ণ কংক্রিটের তৈরি। সেখানে তখন Druk Airways একটি বিমান দাড়িয়ে।
বিমানবন্দরকে বাঁ হাতে ফেলে, পাহাড়ের আকাবাকা রাস্তা ধরে এবার সমতলে নেমে আসার পালা। প্রায় দুপুর তিনটে নাগাদ রওনা হলাম জয়গার দিকে। আসার সময় মাত্র চার ঘন্টায় পৌছে গেলাম। কিন্তু দিনের আলো থাকায় পুরো রাস্তাটা দেখতে পেয়েছিলাম। উপভোগ করতে পেরেছিলাম প্রকৃতির অনন্য রূপ। একই দেশে এত বর্ণময় পাহাড়! কোনওটা সবুজে সবুজ, আবার কোনওটা এতই রুক্ষ যে মনে হয় পাথরগুলো ভাঙা দাতের মত বেরিয়ে আছে। ইচ্ছা করছিল আরও ক’দিন থেকে যাই, কিন্তু চাকরি বাচাতে ফিরে আসতে হল বাস্তবে। সে রাত জয়গার একটি হোটেলে কাটিয়ে, পরের দিন শহরের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে, কিছু কেনাকাটা করা হল। জয়গা আর ফুন্টশোলিং-এর বাসিন্দারা হরদম এপার-ওপার করে। তাই আমরাও চলে গেলাম ওপারে, shopping করতে, পায়ে হেঁটেই। সেলিম ভাই সেই যে গতরাতে আমাদের হোটেলে নামিয়ে উধাও হয়েছেন, অনেক ফোন করেও তাকে ধরা গেল না। আসলে সবাই মিলে ওর জন্য একটা ছোট উপহার কিনেছিলাম, চেয়েছিলাম হাতেহাতে দিতে। কী আর করা। কিন্তু টেলিপ্যাথির জোর, তাও আবার এতগুলো লোকের। দুপুরে সবে রওনা হয়েছি এন জে পির দিকে, আমাদের গাড়ি দাড়িয়ে আছে ট্র্যাফিক সিগনালে, রাস্তার অন্য পাশেও তাই, হঠাৎই হাসি মুখে উদয় হলেন সেলিম ভাই। আমাদের যাত্রা শুভ হোক কামনা করে আবার বোধহয় নতুন পর্যটকদের উেদ্দশে রওনা হলেন। আমরাও তার শুভকামনা করি। যাতে তিনি সর্বদা নির্বিেঘ্ন পাহাড়ি রাস্তা অতিক্রম করে ফিরে আসেন তার আপনজনের কাছে।