আগের রাতেই ই-মেইলে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক পল এ বেক জানিয়ে রেখেছিলেন, কী নিয়ে কথা বলবেন তিনি। তবে তাত্ত্বিক আলোচনার ফাঁকেই সাংবাদিকেরা প্রশ্নটা করে বসলেন তাঁকে, ‘কে যাচ্ছেন হোয়াইট হাউসে?’ মাথা নেড়ে বেক বললেন, বলা মুশকিল। মানুষ দলের চোখ দিয়ে সব দেখে। পুরো দেশ দুই শিবিরে বিভক্ত। দিন দিন বিভক্তি প্রকট হচ্ছে।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে ২৫টি দেশের সাংবাদিক এখন ওহাইওতে। বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক এবং ওই রাজ্যের দুজন সাংবাদিক নির্বাচন ও রাজনীতির হালচাল নিয়ে আসলে যেসব শব্দ উচ্চারণ করলেন, তার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ অতিপরিচিত। এর মধ্যে একটি পরিচিত বিষয় হলো, নির্বাচনে টাকার খেলা। এবার তা এমন পর্যায়ে গেছে যে মার্কিনিরাও তা নিয়ে চিন্তিত।
চার ঘণ্টা ধরে চলা আলোচনার সারাংশ হলো—নির্বাচনে টাকা ছড়ানো, বিরোধী পক্ষের ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসার ব্যবস্থা বন্ধ করা, প্রচার-প্রচারণা থেকে বিস্তর গালমন্দ করা, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর প্রতি আক্রমণাত্মক আচরণ করা—এ সবই চলছে মার্কিন নির্বাচনকে ঘিরে। আর ভোটের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, বিভক্তির কুশ্রী চেহারা ততই কুশ্রীতর হচ্ছে।
পল এ বেক বলছিলেন, ‘কতটা বিভক্তি ভেবে দেখুন। বারাক ওবামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন—রিপাবলিকানদের এই প্রচারণা খণ্ডাতে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট তাঁর জন্মসনদ দেখিয়েছেন। তবু রিপাবলিকানদের অনেকের এখনো বিশ্বাস—বারাক ওবামা মার্কিন নাগরিক নন।’ তিনি বলেন, ২০১২ সালের নির্বাচনেও ডেমোক্র্যাট সমর্থকের ৯৩ শতাংশ ডেমোক্র্যাটদের, আর রিপাবলিকানদের ৯৪ শতাংশ সমর্থক রিপাবলিকান প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। এবারও এর খুব একটা পরিবর্তন হবে না বলেই সব মূল্যায়ন বলছে।
শুধু দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ সবকিছু যাচাই করছে, এটাই একমাত্র সমস্যা নয়। রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে নির্বাচন থেকে ভোটারদের সরিয়ে রাখার চেষ্টা নিয়েও। ফ্লোরিডায় দলটি সফল হয়েছে; নতুন আইনের কারণে সেখানে কয়েক লাখ অপরাধী ভোট দিতে পারবেন না, যাঁদের বড় অংশই আফ্রিকান-আমেরিকান। এ অংশটিকে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা তাঁদের ভোট ব্যাংক বলে মনে করেন।
ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের অধ্যাপক ডেনিয়েল পি তোকাজি বলেন, আদালত স্বাধীন বলেই রিপাবলিকানরা আইন করে নর্থ ক্যারোলাইনা, উইসকনসিন ও টেক্সাসে মানুষকে ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তবে ওহাইওতে সে চেষ্টা চলছে এখনো। টাকা ছড়ানো নিয়েও উদ্বেগের কথা বলেন তিনি। প্রায় বছর খানেক ধরে চলা নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় নানা বিষয়ে লিখেছেন সাংবাদিকেরা। তবে যত দিন পর্যন্ত টাকার খেলা বন্ধ না হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত লেখনী চালিয়ে যাওয়া দরকার বলে মত দেন আলোচনায় অংশ নেওয়া সাংবাদিকেরা।
ওহাইও পাবলিক রেডিওর করসপনডেন্ট জো ইঙ্গেলস বলেন, নির্বাচনে যেকোনো প্রার্থীর প্রচারে যে কেউ নাম গোপন রেখে টাকা দিতে পারেন। এই সুবিধাটা ব্যবসায়ী ও সুযোগসন্ধানী লোকজন ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছেন। নির্বাচনের পর ভোটারদের কথা ভুলে গিয়ে যাঁরা নির্বাচনে টাকা ঢেলেছেন, তাঁদের দিকে প্রার্থীরা নজর দেবেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এটি বিরাট এক অন্তরায়।
টাকাটা কোথায় ও কীভাবে খরচ করা হচ্ছে, তাঁদের কাছে কি খবর আছে, জানতে চাইলে জো বলেন, প্রার্থীরা টাকা দিয়ে টিভিতে চাঙ্ক কিনছেন। যে কেউ যেকোনো চ্যানেলের বাটনে টিপ দিলেই এমন হাজারটা বিজ্ঞাপন দেখতে পাবেন। বিভিন্ন সময় ট্রাম্প নারীদের নিয়ে যা বলেছেন, তার ক্লিপ পরিবারের সবার সঙ্গে বসে শিশুরাও দেখছে; আর হিলারি ক্লিনটন এতে খুবই বিপন্ন বোধ করছেন—এমন একটা বিজ্ঞাপন হরহামেশা প্রচার করছে চ্যানেলগুলো। ট্রাম্পও তাঁর বক্তব্য প্রচারে এমন বিজ্ঞাপনের সুযোগ নিচ্ছেন। আলোচকদের উদ্বেগের বিষয় ছিল, গোটা দেশ দুই শিবিরে বিভক্ত হওয়ায় বিজ্ঞাপনে প্রার্থীরা যে যা বলছেন, তাঁর সমর্থকেরা তা-ই বিশ্বাস করছেন। বিভক্তির কারণে সাংবাদিকদের জন্যও সংবাদ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ডেইলি নিউজের করেসপনডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচার কাভার করতে গিয়েছিলেন ডেটন শহরে। তিনি বলছিলেন, প্রচার অনুষ্ঠান কাভার করতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন, সব সমর্থকই ভেংচি কাটছেন। মিডিয়ার প্রতি তাঁদের নেতা ট্রাম্প রুষ্ট—তাই তাঁরাও রুষ্ট। ওই অনুষ্ঠানের একটি ছবি তিনি সাংবাদিকদের দেখান। এক নারীর টিশার্টের পেছনে ‘কারাগারে হিলারি’ এমন একটি ছবি। তিনি বলেন, অবস্থা এমন যে ফাঁস হয়ে যাওয়া ই-মেইলে কী আছে, তা নিয়ে রিপাবলিকানদের কোনো চিন্তা নেই, তাঁরা এখন প্রতিটি প্রচারে স্লোগান তুলেছেন—‘লক হার আপ’, ‘লক হার আপ’ (তাঁকে জেলে পুরে দাও)।
ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটিতে দিনব্যাপী ওই আলোচনায় অংশ নেওয়া চারজনেরই ভাষ্য—এমন নির্বাচন আগে কখনো তাঁরা দেখেননি। আর নির্বাচনকে ঘিরে যা হলো, তা ভালো হলো না।