আইন পেশায় স্বাগত

can-stock-photo_csp12297912.jpg
আইন সম্মান ও ঐতিহ্যের পেশা হিসেবে বহুকাল ধরে স্বীকৃত। এ পেশায় যেমন বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়, তেমনি অর্জন করা যায় সামাজিক প্রতিপত্তি, অবস্থান ও আর্থিক সচ্ছলতা
সবার আগে আইন ডিগ্রি
প্রথমে আপনাকে এইচএসসির পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হতে হবে। এখানে চার বছরমেয়াদি এলএলবি অনার্স করতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সুযোগ আছে। ভর্তি পরীক্ষায় থাকতে হবে মেধাতালিকার প্রথম সারিতে, বাংলা ও ইংরেজিতে ন্যূনতম নম্বরের শর্তও জুড়ে দেয় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু আছে আইন বিভাগ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যায় নামমাত্র খরচে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুনতে হবে দুই থেকে আট লাখ টাকা। যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্য বিষয়ে অনার্স বা ডিগ্রি পাস করেও আইন পেশায় আসা যায়। এ জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যেকোনো ল কলেজে দুই বছরমেয়াদি এলএলবি (পাস) কোর্স করতে হবে। খরচ হবে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও করা যায় কোর্সটি। এ ক্ষেত্রে গুনতে হবে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা।
পড়াশোনা শেষে আইন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট এনরোলমেন্ট সনদ পরীক্ষায় পাস করতে হয়। পরীক্ষার সিলেবাস পাওয়া যাবে বার কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে। এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে বার কাউন্সিলে। ঠিকানা-বার কাউন্সিল ভবন, ৩ শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণি, শাহবাগ, ঢাকা।
ফোন : ০২-৯৫৬৯৮০৭, ৯৫৬৯৮০৯।
ওয়েব : www.bangladeshbarcouncil.org
কাজের অনেক ক্ষেত্র
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ আলাদা হওয়ার পর বাংলাদেশে আইন পেশার পরিধি বেড়েছে। আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ তো আছেই। এ ছাড়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দিতে পারেন নিম্ন আদালতে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বিভিন্ন বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা, বিভিন্ন দেশের দূতাবাস, বহুজাতিক কম্পানি ও এনজিওতে আছে আইন কর্মকর্তা বা প্যানেল আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সুযোগ।
নিম্ন আদালতে প্র্যাকটিস
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অ্যাডভোকেট এনরোলমেন্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই মিলবে সনদ। একই সঙ্গে হয়ে যাবেন কাঙ্ক্ষিত বারের সদস্য। একজন আইনজীবী একই সঙ্গে দুটি বারের সদস্য হতে পারেন। যেমন-কোনো আইনজীবী ঢাকা বারের সদস্য, তিনি চাইলে একই সঙ্গে অন্য জেলা বারের সদস্যও হতে পারেন। এ জন্য জেলা বারের সেক্রেটারি বরাবর আবেদন করতে হয়। একজন নবীন আইনজীবী সাধারণত সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করেন। পরে সিনিয়র হলে নিজে স্বাধীনভাবে নিম্ন আদালতে প্র্যাকটিস করতে পারেন।
হাইকোর্ট বিভাগে প্র্যাকটিস
নিম্ন আদালতে দুই বছর আইনজীবী হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করা যায়। হাইকোর্টে ১০ বছরের বেশি প্র্যাকটিস করছেন-এমন এক সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে শিক্ষানবিশি চুক্তি করতে হয়। তবে বার-অ্যাট-ল বা এলএলএম পরীক্ষায় কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নম্বর থাকলে এক বছর পরেই আবেদন করা যায়। এ প্রক্রিয়া অনেকটাই নিম্ন আদালতে অ্যাডভোকেট এনরোলমেন্ট পরীক্ষার মতো।
আপিল বিভাগে প্র্যাকটিস
একজন আইনজীবী হাইকোর্ট বিভাগে পাঁচ বছর প্র্যাকটিসের পর আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার জন্য আবেদন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে লাগবে ‘আপিল বিভাগে প্র্যাকটিসের যোগ্য’ এই মর্মে প্রধান বিচারপতি ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের সংখ্যাগরিষ্ঠের দেওয়া প্রত্যয়ন। আর এটি পেলেই আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করেন একজন আইনজীবী।
দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনা
সব মামলাই দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার আওতাধীন। নিম্ন আদালতে অ্যাডভোকেটরা সাধারণত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করে থাকেন। সম্পত্তির ওপর স্বত্ব ও দখলের অধিকার নিয়ে যে মামলা হয়, সেটাই দেওয়ানি মামলা। আদালতের ভাষায় এটিকে ‘মোকদ্দমা’ বলে। সব ধরনের দৃশ্যমান স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি এবং অদৃশ্য সব ধরনের অধিকারসংক্রান্ত মোকদ্দমা আইনজীবীরা জেলা জজ আদালতে পরিচালনা করেন। এ মামলা পরিচালনার জন্য ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, দেওয়ানি কার্যবিধি আইন, সাক্ষ্য আইনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে ভালো দখল থাকতে হয়।
চুরি, ডাকাতি, খুন, মারামারি, ধর্ষণ-অর্থাৎ সংঘটিত অপরাধের বিচার ফৌজদারি মামলার আওতাধীন। এ মামলা আইনজীবীরা ফৌজদারি আদালতে পরিচালনা করে থাকেন। এ মামলা পরিচালনার জন্য ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি ও সাক্ষ্য আইনের বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখতে হয়।
ইনকাম ট্যাক্স আইনজীবী
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রবিউল ইসলাম জানান, আইনজীবী অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর ট্যাক্স বারের সদস্য হতে হবে। আবেদন করতে হবে নির্ধারিত ফরমে। যাঁরা আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, কিন্তু অ্যাডভোকেট না, তাঁরাও চাইলে আয়কর আইনজীবী হিসেবে প্র্যাকটিসের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও ট্যাক্স বারের সদস্য পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। বাণিজ্য বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরাও আয়কর আইনজীবী হওয়ার জন্য এনবিআরে আবেদন করতে পারেন। একই সঙ্গে তাঁদের ট্যাক্স বারের সদস্য হতে হয়।
আয়কর আইনজীবীরা আয়কর, সম্পদ, আমদানি শুল্ক, আবগারি শুল্ক ইত্যাদি বিষয়ে মামলা পরিচালনা করেন। তাঁদের আয়কর অধ্যাদেশ, ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন, সম্পদ বিবরণী-এসব বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখতে হয়।
করপোরেট ল প্র্যাকটিস অ্যান্ড লিটিগেশন
যিনি করপোরেশন আইনে বিশেষ জ্ঞান রাখেন, তিনি করপোরেট আইনজীবী। করপোরেট খাতে আইনজীবীদের কাজের ক্ষেত্র দিন দিন বাড়ছে। করপোরেট আইনজীবী হতে হলে কন্ট্রাক্ট ল, কম্পানি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স, ট্যাক্স ল, অ্যাকাউন্টিং, সিকিউরিটি ল, দেউলিয়া আইন, মেধাস্বত্ব আইন সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন জানান, করপোরেট প্র্যাকটিস হলো যেকোনো বিষয়ে আইনগত মতামত, দলিলপত্র ভেটিং, কম্পানি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠা বিভিন্ন প্রকার ডকুমেন্টেশন প্রস্তুত, করপোরেট অফিসের ব্যবসায়িক লেনদেনের বৈধতা নিশ্চিতকরণ, করপোরেশনগুলোকে তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে লিগ্যাল অ্যাডভাইজ দেওয়া। লিটিগেশন হলো আদালতে মামলা লড়া। আইন বিষয়ে পড়েও বা অ্যাডভোকেট হয়েও কোর্টে প্র্যাকটিস করতে না চাইলে বিভিন্ন ল ফার্মে কাজের সুযোগ পেতে পারেন। ল ফার্মগুলোতে বিভিন্ন কম্পানির ডকুমেন্টেশন প্রস্তুত, লিগ্যাল অ্যাডভাইস দেওয়া, ফাইল তৈরি, মামলার ড্রাফট তৈরির কাজ করতে পারেন।
অন্যান্য
বাংলাদেশে তেমন প্রচলন না থাকলে সাইবার ক্রাইম, ইমিগ্রেশন, স্পোর্টস ও মিডিয়া আইনজীবী হলে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পেতে পারেন কাজের সুযোগ। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে সাইবার বিষয়ে নানা ধরনের আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। আর মিডিয়া, মিডিয়াকর্মী বা সেলিব্রিটিদের বিভিন্ন আইনি জটিলতার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের কদর বাংলাদেশেও তৈরি হচ্ছে।
ভালো করার উপায়
আইনজীবীদের আয়ের বিষয়টি নির্ভর করে অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত দক্ষতা, সামাজিক যোগাযোগ, মামলার ধরন ও মক্কেলের ওপর। ব্যারিস্টার এম সরোয়ার হোসেন জানান, ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগের একজন আইনজীবী। বার-অ্যাট-ল ডিগ্রি থাকলে মক্কেলদের কাছে বাড়ে গ্রহণযোগ্যতা। আইন পেশায় সদ্য যোগদানকারী ঢাকা বারের সদস্য বশির আহমেদ জানান, একজন নতুন আইনজীবী সাধারণত ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। জুুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা সহকারী জজ পদে নিয়োগ পেলে সম্মান, নানা সুযোগ-সুবিধাসহ মিলবে মোটা অঙ্কের বেতন। আইন পেশায় সফল হতে হলে ধৈর্য, অধ্যবসায়, অভিজ্ঞ সিনিয়রের সান্নিধ্য, আইন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় দখল থাকতে হবে। বাড়াতে হবে বাগ্মিতা, চিন্তার প্রখরতা, সামাজিক যোগাযোগ।
– আল-আমিন খান, কালের কণ্ঠ অনলাইন থেকে
أحدث أقدم