মেয়েটার সেদিন একটু বেশিই মন খারাপ ছিল
হয়তো সেজন্যই নিজের ইচ্ছায় আমাকে
বলেছিল 'কেমন আছেন' এরপর থেকেই
আমাদের প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ে চ্যাট হত। মেয়েটা
তার জীবনের গল্পগুলো বলতে লাগলো আর
আমি মনের অজান্তেই তাকে ভাললাগতে লাগলো।
এভাবেই আমাদের সম্পর্কটা চলতে চলতে
মেয়েটি জানালো
সে আমাকে ভালবেসে ফেলেছে। আমিও
বলে দিলাম তাকে আমিও ভালবাসী।
এরপর দুজনের প্রতিদিনই চ্যাট, ফোনে কথা বলা
হত। মেয়েটি প্রথম প্রথম খুব কেয়ার করতো
আমাকে। ঘুম থেকে সকালে উঠিয়ে দিত, নাস্তা না
করা পর্যন্ত ফোনের লাইন কাটতো না। অফিসে
যাওয়ার পর সে বারবার কল দিত। ভীষন ভালো
লাগতো আমার বিষয়গুলো।
মেয়েটির সাথে দেখা করতে চাইলাম, মেয়েটি
বললো সে দেখা করতে পারবে না। সবসময়ই
সে অজুহাত দেখাতো আমি সেটা মেনে নিতাম।
একদিন ভীষন জ্বর আমার, মেসে থাকতাম
যেহেতু মা পাশে নেই যে যত্ন করবে।
মেয়েটিকে কল দিয়ে বললাম 'তোমাকে
একটিবারের জন্য দেখতে চাই ' মেয়েটি বললো
'তোমাকে যেহেতু ভালবাসী অবশ্যই আমাদের
দেখা হবে '
জ্বর ভালো হলো তিনদিন পর। মেয়েটি নাম্বারে
বহুবার কল দিয়েছি কিন্তুু তার মোবাইল সুইচ অফ ছিল।
ফেসবুক ম্যাসেন্জারে কোথাও মেয়েটিকে
পাওয়া গেল না কারন তার আইডিও ডিএ্যাকটিভ।
ভেবে নিলাম হয়তো মোবাইলে কোন সমস্যা।
মেয়েটি একদিন খুব কেঁদে কেঁদে বলেছিল
আমাকে ছেড়ে তার বেঁচে থাকাটা অসম্ভব হবে।
আজ ৭দিন হলো অথচ মেয়েটির কোন
খোঁজখবর নেই। কেমন আছে মেয়েটি?
খুব ভোরে সেদিন ফোন বেজে উঠে,
অপরিচিত নাম্বার
হ্যালো আপনি কি মাহিম
জ্বি বলুন বলতেই একটি মেয়ে কন্ঠ বলে
উঠলো ক্যাপিটাল হাসপাতাল থেকে বলছি ।
চমকে উঠি মায়ের কথা মনে হলো, মা তো
অসুস্থ বেশ কয়েকমাস ধরে। বললাম জ্বি বলুন
কাকে চাই?
আপনি কি রিশাকে চিনেন? তিনি কিছুক্ষণ আগে মারা
গেছেন।
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। মেয়েটির
কাছে হাসপাতালের পুরো ঠিকানা নিয়ে হাসপাতালের
দিকে ছুটলাম ...
তারপর মেয়েটির সাদা কাপড়ের ঢেকে থাকা মুখখানি
দেখে আরো বেশি চমকে যাই এবং তার মা বাবা
সকল আত্তীয়স্বজনরা বলতে লাগলো এই
ছেলে তোমার নাম কি মাহিম আমি জ্বি বলতেই
মেয়েটির মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে
দিলেন আর বললেন "রিশা তোমাকে খুব
ভালবাসতো সে চেয়েছিল তোমার সাথে দেখা
করবে কিন্তুু বাবা তুমি রিশাকে মাফ করে দিও "
আমি তখনও মেয়েটার মিষ্টি মুখটার দিকেই তাকিয়ে
ছিলাম আর শুনতে পেলাম মেয়েটা ক্যান্সারে মারা
গেছে। ওর সাথে আমার পরিচয় যখন, তখন
মেয়েটি ছিল লাস্ট স্ট্রেজে। মেয়েটি আমাকে
এতটাই ভালবাসতো যে সে তার মরনব্যাধি রোগটার
কথা গোপন করে। আমাকে একটিবার দেখার জন্য
নাকি তার মা বাবাকে বারবার অনুরোধ করেছিল ।
মেয়েটির মা সেন্স হারালো, তাকে পাশের
কেবিনে রেখে চিকিৎসা চলতে লাগলো আর আমি
অপলক তাকিয়ে রইলাম আমার ভালবাসার মানুষটির মুখের
দিকে। এত সুন্দর এত মায়াবী হতে পারে মানুষ?
আমার তারপর কিছুই মনে নেই।
প্রায় তিনঘন্টা পর শুনেছি আমি ও সেন্স হারিয়ে
ফেলেছিলাম। আমাকে মেয়েটির বাসায় তারা নিয়ে
আসে লাশবাহী গাড়ীর সাথেই।
মেয়েটির শোবার ঘরে আমাকে শুইয়ে দিয়েছিল
তারা ।
তাই টেবিলের উপর একটি সবুজ ডাইরীটা আমার
চোখে পড়লো। সেখানে মেয়েটি চিঠির মত
করে লিখেছিল
" প্রিয় মাহিম
তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও,
তোমাকে আমার জীবনে পেয়ে আমার খুব
বাঁচতে ইচ্ছে করছে। কিন্তুু আমি যে মাত্র আর
কিছুদিনই আছি। তোমার জ্বর অথচ তোমাকে
দেখতে যেতে পারছি না। জানো কেনো? যদি
তুমি আমায় দেখামাত্র ঘৃণা করো, যদি তুমি আমায়
অপছন্দ করো, যদি আমার ক্যান্সার হয়েছে
জেনে দুরে সরে যাও তাহলে আমি যে সময়ের
আগেই মরে যাব। কতদিন তুমি আমার পিক দেখতে
চেয়েছিলে আমি দেইনি। কতদিন তুমি আমার হাতটি
ধরে হাঁটতে চেয়েছিলে আমি পারিনি তোমাকে
বলতে আমার ডান হাতে ক্যানোলা লাগানো। তুমি
মেলা থেকে নুপুর কিনে বলেছিলে আমার পায়ে
পড়িয়ে দিবে। আমি সেদিন বলতে পারিনি আমার একটি
পা নেই। তোমার কোন আবদারই আমি পূরণ
করতে পারিনি শুধুমাত্র তোমাকে পেয়ে হারানোর
ভয়ে।
আমাকে নিয়ে তুমি সংসার করতে চেয়েছিলে কিন্তুু
তুমি জানো না আমি বেঁচে থাকলেও কোনদিন
তোমার সন্তানের মা হতে পারতাম না।
কারন একদল নরপশুর দল আমাকে জোড়পূর্বক
ধর্ষন করেছিল একটি পরিত্যক্ত বাড়ীতে। আমি
কলেজ থেকে বাসায় আসার পথে তারা আমাকে
টেনেহেঁচরে একটি গাড়ীতে উঠিয়ে নিয়ে
আসে এবং সারাদিন, রাত তারা ৫জন আমাকে ধর্ষন
করে সকালে আমার বাবা মায়ের কাছে দিয়ে যায়।
আমি ৭টা মাস কারো সাথে কথা বলতে পারিনি, কারো
সামনে যাইনি। আমার অপরাধ কি ছিল জানো মাহিম আমি
অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলাম।
আমার এক বান্ধুবী কে তার বয়ফ্রেন্ড জোর
করে ধর্ষন করার রাজসাক্ষী হবার কারনে ওরা
আমাকেও রাতভর ভোগ করে। আমার মাতৃিত্বকে
নস্ট করে। এমনকি আমার ডান পা, ডান হাত এমনভাবে
জখম করে যে আমার পা পুরোপুরি অকেজো
হয়ে যায় এবং ইনফেকশন জনিত কারনে ক্যান্সারের
জন্ম নেয়।
তুমি শুনছো মাহি? আমাকে প্লিজ মাফ করে দাও।
তোমাকে এভাবে এতটা ভালবাসার স্পর্ধা দেখানো
ঠিক হয়নি আমার কিন্তুু কেনজানি মনে হয়েছিল তুমি
ছেলেটা ওদের মত নরপশু নও। তোমার একটি
স্ট্যাটাস পড়ে আমি তোমার প্রেমে পড়ি। জানো
কোনটা?
ঐ যে তুমি স্বাধিনতা দিবসে লেখেছিলে
'মেয়েরা কবে স্বাধীন মত রাতের রাস্তায়
হেডফোন কানে হেঁটেঁ হেঁটে বাড়ী
পৌঁছাবে"? মেয়েরা কবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে
ধর্ষিতদের ন্যায় বিচার দিবে?
তোমার মধ্যে আমি সেদিন দেখেছি আমার সাথে
ঘটে যাওয়া ন্যায়বিচারের প্রতিবাদ। হ্যা তুমি পারবে
ছেলে হয়ে মেয়েদের পক্ষে লড়াই করতে?
বলো পারবে মাহিম
আমার প্রশ্নের উত্তর আমি বেচে থাকতে
হয়তো পাবো না, ডাক্তার আংকেলকে বলতে
শুনেছিলাম আমার সময় শেষের দিকে । গত এক
বছরে মা কে দেখিনি হাসতে। মাহিম তুমি আমার মাকে
আগলে রেখো ................
# ডাইরীটা নিয়ে সোজা চলে গেলাম রিশাকে বিদায়
দিতে। জানাযায় কতজনে কত রকম কথা বলতে
শুনেছি। আমি চুপ কারন আমার অনেক কাজ বাকী।
এই দেশটা ঠিকিই স্বাধিনতা পেল কিন্তুু আমার রিশা
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যেয়ে স্বাধিনতা
হারালো। আমি কাঁদবো না একদমই নাহ।
আমার ভালবাসা এত ঠুনকো ছিল না যে রিশার সাথে
ঘটে যাওয়াকে মামুলি বিষয় মনে করে আবার একটি
নতুন প্রেমে পড়বো। আমি পুরুষ কান্না নয়
ন্যায়ের জন্য লড়াই করা মানায়। শুধু একজন রিশার জন্য
আমি লড়াই করবো না, অসংখ্য ধর্ষিত রিশাদের পাশে
আমি থাকবো। তাদের ন্যায়বিচার না দিলে আমার মৃত্যু
হবে না কোনদিন ।