“তোমার সংসারে থেকে আমি কি পেলাম?” রাগে গজরাতে গজরাতে বলতে থাকে আশিকের স্ত্রী সোনিয়া। “বাবাকে খুশী করতেই তোমার সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। বাবা ভেবেছিল পাত্র ভালো চাকরি করে তার মেয়েকে সে সুখে শান্তিতে রাখতে পারবে। কিন্তু বাবা কি জানত তার মেয়ের জামাই একটি বোকা হাঁদারাম। তার বন্ধুরা যেখানে ফ্ল্যাট আর গাড়ি বাড়ীর মালিক হয়ে বিলাসী জীবন কাটাচ্ছে তিনি তখনও অন্যের বাড়িতে ভাড়া করে থাকেন। মাস শেষে উনার পকেটের চাইতে সাহারা মরুভূমিতেও ধন সম্পদ বেশী থাকে” সোনিয়া বিছানা গোছাতে গোছাতে বলতেই থাকে কিন্তু আশিক নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে পত্রিকায় নজর বুলাতে থাকে।
সোনিয়া বলতে থাকে, “এরচেয়ে ঐটাই ভালো ছিল ভালবাসার মানুষের হাত ধরে চলে যেতাম। কিন্তু বাবা মায়ের মুখে চুনকালি পরবে এটা ভেবেই গেলাম না”।
“আহারে! কেন যে গেলে না” আশিক আফসোসের সুরে বলে উঠে।
সোনিয়া এতে আরো ক্ষেপে যায়, “কি বললে তুমি?”
“আমি! কই কিছু-ইতো বলিনি” আশিক কিছুই না বলার ভান করে।
সোনিয়া রাগে চোখ মুখ লাল করে পাশের রুমের গিয়ে ঘুমিয়ে থাকা অহনার পিঠে জোরে থাপ্পড় দিয়ে ডেকে তুলে, “এ দেখি রাজরানীর মতো ঘুমোচ্ছে, স্কুলে যাবে কে শুনি?” থাপ্পড় খেয়ে অহনা ঘুম ভেঙে বিছানা থেকে কেঁদে কেঁদে উঠে বসে।
পাশের রুম থেকে আশিক জবাব দেয়, “আহা, তুমি ওকে মারছ কেন?”
“মারব না, তো কি আদর করব? আমাদের মা মেয়ের ব্যাপারে তুমি নাক গলাবেনা বলে দিলাম”
“অহনা যেমন তোমার মেয়ে, তেমনই আমারো”।
“মেয়ের প্রতি কেমন ভালোবাসা তাতো দেখিই, ওর সবকিছু-তো আমাকেই করতে হয়”
“আচ্ছা নাস্তা দাও অফিসের দেরী হয়ে যাচ্ছে, অহনাকে রেডি করে দাও আজ আমিই ওকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাব” আশিক পত্রিকা সেলফে রেখে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নেয়।
সোনিয়ার আর্তনাদ তখনো থামেনা, সে বলতে থাকে “একটা কাজের মেয়েও পাওয়া যায়না যে কাজে একটু সাহায্য করবে, একা একা সব কতদিন আর করা যায়”
“তোমার কষ্ট কমাতে আগামী সপ্তাহেই আজিজ কাজের মেয়ে নিয়ে আসছে। এই ক’টা দিন ধৈর্য ধরো লক্ষ্মীটি”। আশিকের এই প্রতিশ্রুতিতে সোনিয়া কিছুটা শান্ত হয়। সে টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে অহনাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করে দেয়। আশিক নাস্তা সেরে সোনিয়াকে বিদায় জানিয়ে অহনাকে নিয়ে বেড়িয়ে পরে।
আশিক একটি পোশাক তৈরি কারখানায় মারচেন্ডাইজার হিসেবে কাজ করে। সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ডিউটি হলেও ছয়টায় কখনোই বের হওয়া হয়ে উঠে না। কাজের চাপে বেরুতে বেরুতে রাত আটটা নয়টাও বেজে যায়। অনেকদিন যাবত সে একই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। এখানে সকলের সাথে মায়ার বন্ধন সৃষ্টি হওয়ায় বেতন কম হওয়া সত্ত্বেও ছাড়তে পারে না। সে সৎ ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যায়। তার বন্ধুরা যারা একই সাথে লেখাপড়া করে বেরিয়েছে তাদের অনেকেই এখন ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে বেশ ভাল অংকের বেতনে চাকরি করছে। অনেকে আবার বিভিন্নভাবে অবৈধ উপায়েও টাকা উপার্জন করছে। আশিক কখনোই অবৈধভাবে টাকা উপার্জনের কথা চিন্তা করেনা। নিজের মাথা ঘামিয়ে মাস শেষে যা উপার্জন করা যায় তাতেই সে শান্তি পায়। হয়ত এই টাকায় তার সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয় তবুও তার মনে একটি আত্মতৃপ্তি থাকে। সে বিশ্বাস করে সকলে নিজ নিজ যোগ্যতাতেই উপরে উঠে যায়। তার যেরকম যোগ্যতা রয়েছে সে হয়ত তেমনই পাচ্ছে।
সোনিয়ার সাথে তার বিয়ে হয় সাত বছর আগে তখন সে সবে চাকরিতে প্রবেশ করেছে। সোনিয়ার বাবা মোতালেব সাহেব আশিকের কথায় ও আচরণে খুশী হয়ে সোনিয়াকে তার হাতে তুলে দেয়। আশিক সোনিয়াকে সুখী রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় কিন্তু কিছুতেই সোনিয়াকে তৃপ্ত করতে পারেনা। সোনিয়া সবসময়ই অন্যের সাথে নিজেদের অবস্থার তুলনা করে ভেতর ভেতর অনুশোচনায় জ্বলতে থাকে। প্রতিদিন সকাল হলেই তার কণ্ঠ থেকে আগুন ঝরতে থাকে। আগুনের ফুলকি হয়ে বের হয় আশিকের বিভিন্ন বন্ধুদের গাড়ি বাড়ির ফিরিস্তি, তাদের বউয়ের পোশাক-আশাক আর অলঙ্কারের ফিরিস্তি। আশিকের এসব শোনতে শোনতে অভ্যাস হয়ে গেছে এখন আর এসব তাকে তেমন পুড়ায়না। তবে অহনার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে নতুন কিছু করার চিন্তা ভাবনা করে। কিন্তু কি করবে তা এখনো ভেবে উঠতে পারেনা।
অহনা লিটল এঞ্জেল স্কুলের নার্সারিতে পড়ে। তার স্কুল বাসা থেকে খুব দুরে নয়। হেটে যেতে সময় লাগে সাত মিনিট। প্রতিদিন তাকে তার মা সোনিয়া স্কুলে দিয়ে যায় এবং ছুটির সময় এসে নিয়ে যায়। আজকের আগে আশিক কেবল একদিনই অহনাকে নিয়ে স্কুলে এসেছিল সেটি ছিলো ওর স্কুলে ভর্তি দিনই। স্কুলে যেতে যেতে অহনা তার বাবাকে বলে, “বাবা, তোমাকে একটি কথা বলি?”
আশিক উৎসুকভাবে বলে “বলো মা কি কথা?”
“আজ স্কুলে না গিয়ে চল আমরা কোথাও থেকে ঘুরে আসি”
“তোমাকে নিয়ে ঘুরতে পারলে আমারো মজা লাগত কিন্তু মা তোমাকে যে স্কুলে যেতেই হবে, আর আমারকেও অফিসে যেতে হবে। তোমাকে নিয়ে অন্যকোন দিন ঘুরতে বের হবো”
বাবার কথা শোনে অহনার মন খারাপ হয়ে যায়। তবুও আগামীতে ঘুরতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে খুশী হয়। বাবা, তোমাকে আরেকটা কথা বলি?”
“হুম বলো মা”
“তুমি আর মা প্রতিদিন সকালে ঝগড়া করো কেন?”
“এটা ঝগড়া নয় মা, এটাও এক ধরনের ভালোবাসা। তুমি বড় হলে বুঝবে”
ঝগড়াঝাঁটির ভেতর কি ধরনের ভালোবাসা থাকতে পারে তা অহনার ছোট মাথায় ধরল না। কথা বলতে বলতে তারা স্কুল গেটের সামনে চলে আসে। আশিক অহনাকে কিছু চকলেট কিনে দিয়ে তাকে স্কুলের ভেতর রেখে এসে অফিসের পথে যাত্রা করে।
আশিক ও অহনা বের হয়ে যাওয়ার পর বাসায় সোনিয়া একা। এমন সময় সে প্রতিদিন একাই থাকে। একাকীত্ব তার একদম সহ্য হয়না। কথা বলার মতো কাউকে না পেলে কি আর ভালো থাকা যায়। এই সময়ে সে নাস্তা করে খাবার দাবার ঘুচিয়ে টেলিভিশনের সামনে বসে। কিন্তু টিভি দেখাতেও তার মন বসে না। সে আশিকের বন্ধুর স্ত্রীদের ফোন দিয়ে খোশ গল্প করে। কিন্তু তাদের খোশ গল্পে কেবলই মিশে থাকে কে নতুন কি কিনল, তাদের স্বামী তাদের কি গিফট করেছে এসব। এসব শোনতে শোনতে সোনিয়ার আর ভালো লাগেনা। কিন্তু সে কি করবে তা ভেবে পায় না। আশিক বলেছে আগামী সপ্তাহে আজিজ কাজের মেয়ে নিয়ে আসবে তখন হয়ত কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া যাবে। আজিজ আশিকের চাচাতো ভাই, সে মাঝে মাঝেই বাসায় এসে থেকে যায়। কিন্তু কাজের মেয়ে কতদিন থাকবে তা ঠিক নেই। আগেও অনেককে আনা হয়েছে কিন্তু কেউই ঠিকতে পারেনি। সকলের মতে তার জন্যই কেউ ঠিকতে পারেনা কিন্তু তার দোষটুকু কোথায় তা সে বুঝতে পারেনা। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক এবারের মেয়েটিকে জোর করে হলেও থাকতে বাধ্য করা হবে।
সোনিয়ার মোবাইল নম্বরে তখন অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোন আসে। সোনিয়া ফোনটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওর অতি পরিচিত একটি কণ্ঠস্বর বলে ওঠে, “যদি ভুল না হয় তাহলে আমি সোনিয়ার সাথেই কথা বলছি”
—-পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষা করুন—-