চোখের দেখাই যেন সব নয়। সেই দেখার বাইরেও অনেক কিছু শেখার থাকে। তাই
তো এই প্রজন্মের কাছে ভ্রমণ যেন শুধু সময় ব্যয় নয়; বরং নিজের চারপাশ ঘুরে
দেখা, নিজের অস্তিত্বকে চিনতে শেখা, নিজের ঐতিহ্য আর ইতিহাসকে ধারণ করা।
পাশাপাশি চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জীবনের ঐতিহ্য থেকে অস্তিত্বের অনুভবকে তীব্র
করা। তাই আমাদের এই সংখ্যায় থাকছে ভ্রমণবিদদের কথা ও এই পেশায় জড়িত
কয়েকজনের গল্প। আয়োজনটি সম্পাদনা করেছেন রিয়াদ খন্দকার ও গ্রন্থনা করেছেন
সাজেদুল ইসলাম শুভ্র ও আহসান রনি
বর্তমান তরুণ সমাজের মাঝে
ভ্রমণের নেশাটা বেশ জেঁকে বসেছে, যা দেশ ও জাতির জন্য এক আলোকিত বার্তা।
কোনো একটা সময় সমাজ-সংসার ভ্রমণটাকে বিলাসিতা ভাবত। এখন কিন্তু তা নয়,
মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে সেইসঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে ভ্রমণ সম্পর্কে
ইতিবাচক ধারণা। আর এর মূলে রয়েছে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একদল
কর্মীর নিরলস প্রচেষ্টা। যারা তাদের ফিচার আয়োজনগুলোতে বিশেষভাবে ভ্রমণ
সম্পর্কে দর্শক ও পাঠকদের জন্য বিভিন্ন আগ্রহমূলক গল্প প্রকাশ করে বা
প্রতিবেদন তুলে ধরে। যার ফলে এখন তরুণদের ছাপিয়ে নানা বয়সের মানুষের মনেও
সুযোগমতো ভ্রমণে যাওয়ার দুর্নিবার আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে।
এখন আসি মূল প্রসঙ্গ ‘দেখতে গিয়ে শেখা’য়। আমরা যারা ভ্রমণ করতে ভালোবাসি
তাদের সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে ভ্রমণে যাওয়ার জায়গা যেমন নতুন কিছু খুঁজি
ঠিক তেমনি করে নতুন পরিবেশে গিয়ে ভালো কিছু শেখার যেন চেষ্টা করি। প্রতিটি
রাষ্ট্র, মহানগর, জেলা, গ্রাম যেখানেই যাই না কেন সেখানকার প্রকৃতি ও
পরিবেশ এবং মানুষের কাছ থেকে শেখার রয়েছে অনেক কিছু। পাহাড়ে যখন যাবেন তখন
দেখবেন আদিবাসী মানুষগুলো কত কষ্ট করে তাদের যাপিত জীবন পার করছেন। এরপরেও
তাদের মাঝে রয়েছে শৃঙ্খলা, অধ্যবসায়, নিয়মানুবর্তিতা যা আমাদের শহুরে
সমাজেও অনেকটা অনুপস্থিত। আমি একবার গহীন পাহাড়ের এক পাড়াতে বন্ধুরা মিলে
মজাদার খাবার খাচ্ছি ঠিক তার পাশেই ছিল বেশ কয়েকজন শিশু। পরবর্তী সময়ে
জানতে পেরেছিলাম তারা ছিল অভুক্ত কিন্তু এরপরেও শিশুরা আমাদের দিকে তেমন
করে ফিরেও তাকায়নি যা আমাকে সত্যিই আপ্লুত করার পাশাপাশি অন্যকে বিরক্ত না
করার শিক্ষা দিয়েছে। পাহাড়িদের দেখবেন কঠোর পরিশ্রমের পরেও রাতের ঘুমকে
প্রলম্বিত করেন না। নারী-পুরুষ সবাই আবার খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যে যার মতো
কাজে চলে যায়—কোনো অলসতা বা অতি নিদ্রা নয়। অথচ আমরা? তাই এখানেও
সময়ানুবর্তিতা বিষয়ে শেখার আছে। ভ্রমণের পাশাপাশি নতুন কিছু দেখার সাথে
সাথে ভালো কিছু শেখার মধ্য দিয়ে নৈতিক উত্কর্ষেরও যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
ভ্রমণের স্থান কোনো ধার্মিক ব্যক্তির দরবারও হতে পারে যেখান থেকে শেখা যাবে
ধর্মীয় রীতিনীতি। লাভ করা যাবে আত্মশুদ্ধি। ভ্রমণপিপাসুরা নিজ নিজ ধর্ম
অনুযায়ী যেতে পারেন তাদের উপাসনালয়ে, শিখতে পারবেন নিজেকে আদর্শ মানুষ
হিসেবে গড়ে তোলার দিক্ষা, কারণ প্রত্যেক ধর্মেই রয়েছে সত্ কাজের আদেশ আর
অসত্ কর্ম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ। ভ্রমণকে শুধু হই-হুল্লোড় আর ভুরিভোজের
মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শেখার মানসিকতা রাখতে হবে। অনেকেরই ধারণা, ভ্রমণে
আবার শেখার কী আছে! ভ্রমণ মানেই হলো জাগতিক সুখে সেই সময়টুকুতে ডুবে থাকা।
যা এক সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যে চলতে হলে ভ্রমণই হলো
একমাত্র পন্থা যেখান থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। খুব কাছের বন্ধুকেও ভালোভাবে
জানতে হলে ভ্রমণসঙ্গী করে নেওয়া যায়। ইসলাম ধর্মে ভ্রমণ করা সুন্নত।
বন্ধুরা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ভ্রমণের গুরুত্ব। কনকনে শীতে যখন হাওড় বা বিলে
যাবেন তখন দেখবেন জেলেরা কত সকালে ধনীদের রসনা মেটানোর জন্য বুক সমান
পানিতে নেমে আছে মাছ ধরার জাল নিয়ে। কৃষকেরা ক্ষেতে ধানকাটা কিংবা বীজ বুনে
যায়। অথচ আমরা সুযোগ পেলেই ‘চাষা’ বলে তাদের উপহাস করি। এই জেলে-চাষিরা
যদি এই কাজ না করত তাহলে কি আমাদের ডাইনিংয়ে মজাদার মাছের পেটি ও
সুগন্ধিযুক্ত চালের ভাত শোভা পেত? এগুলো দেখে শিখতে হবে, কথায় কথায় গ্রাম
থেকে আসা সহজ সরল মানুষটাকে চাষার ছেলে বলে গালি বা উপহাস করা এমনিতেই বন্ধ
হয়ে যাবে। যখন কোনো উন্নত রাষ্ট্রে যাবেন তখন দেখবেন সেখানকার মানুষগুলো
কত ব্যস্ত অথচ ফাঁকা রাস্তায়ও লালবাতি জ্বলাকালীন সময় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
যেখানে সেখানে আবর্জনা না ফেলে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলছে। তাদের প্রকৃতি ও
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জনগণ কতটা আন্তরিক। অন্যের কষ্ট কিংবা অসুবিধা হয়
এমন কাজ থেকে তারা বিরত থাকেন। বন ধ্বংস, পাহাড় কাটা, নদী ভরাট এগুলোত করা
দূরে থাক তারা বিশেষ কারণে গাছের একটি ডাল কাটার আগেও ভেবে নেয় কয়েকবার।
আমরা যখন বিদেশে ভ্রমণ করতে যাব তখন এই সব বিষয় শিখে এসে নিজ দেশে নিজেদের
দৈনন্দিন জীবনে প্রতিফলনের চেষ্টা করব। দেশে এসে বৃক্ষ কাটার চাইতে নতুন
চারা রোপনে উত্সাহিত হব। ভ্রমণে গিয়ে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখা যায়,
তা হলো ভদ্রতা। একাডেমিক শিক্ষা অর্জন করে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করা যাবে
কিন্তু আদব-শ্রদ্ধা, মার্জিত কথোপকথন রপ্ত করতে হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ
ভ্রমণে গিয়ে শিখতে হবে। আর যাদের বিদেশ ভ্রমণের সামর্থ্য নেই তারা চলে যান
বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের গভীরে যেখানে এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি অথচ
তাদের কাছ থেকে শেখার রয়েছে সততা, ভদ্রতা ও একাগ্রতা। পৃথিবীর যে প্রান্তেই
ভ্রমণে যান না কেন জাগতিক আনন্দের চাইতে ভালো কিছু শেখার আগ্রহ রাখুন
আপনার ধ্যানে মনে। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শেখার শেষ নেই। পরিশেষে আমাদের
স্লোগান হোক—‘ভ্রমণের পাশাপাশি শেখার আছে, সেই শিক্ষার মাঝে ব্যক্তি ও
সমাজের উন্নয়ন রয়েছে।’
লেখক : চিফ অর্গানাইজার, দে-ছুট