কুরআনের শিক্ষা
সীরু ফীল আরদ-তোমরা পৃথিীবীতে ভ্রমন কর’
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষা ভ্রমন: তাৎপর্য ও করণী
সন্মানিত সভাপতি , মেহমানবৃন্দ ও প্রিয় ডেলিগেট ভাই-বোনেরা
আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। আমাকে কনফারেন্স ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সীরু ফীল আরদ- তোমরা পৃথিীবীতে ভ্রমন কর’ শীর্ষক বিষয়ে কুরআনের শিক্ষা সংক্ষেপে উপস্থাপন করতে। এই বিষয়ে আলোচনার শুরুতে আমি কুরআন সম্পর্কে ভূমিকা স্বরুপ কিছু কথা বলতে চাই। তারপর পঠিত কুরআনের আয়াতগুলোর আলোকে কয়েকটি বিষয় সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। বিষয়গুলো হচ্ছে:
ক্স ইসলামের দৃষ্টিতে ভ্রমন ও শিক্ষা ভ্রমন
ক্স কুরআনে বর্ণিত পৃথিবী ভ্রমনের উদ্দেশ্য ও ফায়দা
ক্স ভ্রমন কালীন সময়ে করণীয় সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের দিকনির্দেশনা
ভূমিকা: কুরআন কি ও কেন?
মূল আলোচনার পূর্বে কুরআন কি ও কেন এই বিষয়ে দু’একটি কথা বলা জরূরী মনে করছি। আমরা জানি কুরআন আরবী শব্দ ।
ক্স অধিকাংশ ভাষাবিদদের মতে এটির মূল উৎস হচ্ছে আরবী কারউন শব্দ । যার অর্থ পাঠ করা। এটি পৃথীবীর সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ। কেননা কুরআন এমন একটি কিতাব যা তিলাওয়াত করলেও সাওয়াব আছে। মান কারাআল কুরআনা হারফান ফালাহু আশরু আমছালিহা- যে ব্যক্তি কুরআনের একটি বর্ণ তিলাওয়াত করবে সে কম পক্ষে প্রতিটি বর্ণের জন্য দশ নেকী পাবে। এই কারণে কুরআন তিলাওয়াতের সময় ফেরাউনের নাম উচ্চারিত হলেও এটার জন্য সওয়াব পাওয়া যাবে।
ক্স কুরআন এমন একটি গ্রন্থ যার তিলাওয়াত শুনলেও সওয়াব আছে। কোন মজলিসে কুরআন তিলাওয়াত হলে সেই মজলিসে উপস্থিত ব্যক্তিদেও জন্য শোনা কর্তব্যও বটে। ইযা কুরিয়াল কুরআনু ফাসতামি ওয়া আনসিতু- অর্থাৎ তোমাদের উপর কুরআন তিলাওয়াত হলে তোমরা মনোযোগ সহকারে শোন ও তিলাওয়াতের সময় চুপ থাকো।
ক্স এটি এমন কিতাব যা শিখলেও সওয়াব শিখালেও সওয়াব। আল্লাহর রাসূল (সা) বলেণ, খায়রুকুম মান তাআল্লামাল কুরআনা ওয়া আল্লামাহু-তোমাদেও মধ্যে সেই সর্বোত্তম যে কুরআন নিজে শেখে ও অপরকে শেখায়। হাদীস অনুযায়ী প্রভাতে কুরআনের একটি ইলম অর্জন এক শ রাকাত নফল থেকে উত্তম
ক্স যার অন্তরে কুরআন আছে সে অন্তর দোজখে জ্বলবেনা। কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। আর যার পেটে কুরআন নেই সে ভাংগা ঘরের ন্যায়
ক্স কুরআনের পরিচয় কুরআনে আহসান আল ক্বাসাস- সর্বোত্তম কাহিণী, মাওয়েয আল হাসানা- সর্বোত্তম উপদেশ; ফুরকান তথা সত্য ও মিথ্যা নির্ণয়ের মানদন্ড, নূর তথা আলো প্রভৃতি ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে কুরআন কি সম্পর্কে আলোচনা আছে? এই প্রসংগে কুরআনের শুরুতেই বলা হয়েছে কুরআন হচ্ছে- হুদান লিল মুত্তাকীন- তথা মুত্তাকীনদের জন্য জীবন বিধান । অন্যত্র এসছে- হুদান লিন নাস অর্থাৎ সমস্ত মানবতার জন্য জীবন বিধান। তাই এতে মানবতার জীবনের সকল দিক ও বিভাবেগর মৌলিক দিক নির্দেশনা রয়েছে। এতে আল্লাহর যাত সিফাত- তথা আল্লাহ আমাদের রব, খালেক,মালেক,রাজ্জাক- আইন দাতা, হুকুমদাতা প্রভৃতির বয়ান আছে। আল্লাহর রাসূলের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। আখিরাতের সঠিক দৃষ্টিভংগী উপস্থাপিত হয়েছে। অনুরপভাবে হকুকুল্লাহ তথা নামাজ, রোজা, হজ্জ,যাকাত প্রভৃতি ইবাদত পালনের কথা আছে। তদ্নারুপ হালাল হারাম তথা সুদ, মদ,জুয়া লটারী প্রভৃতি হারাম এই সংক্রান্ত বিধি বিধান আছে। উকুবাত তথা চুরি, যেনার, মিথ্যা অপবাদেও শাস্তি বিধান সম্পর্কে আলোচনা আছে। চরিত্র গঠন সম্পর্কে সুরা লোকমান ,মুমিুনুন ও ফুরকানসহ বিভিন্ন সূরায় আলোচনা আছে। পারস্পরিক সম্পর্ক ও দায়িত্ব তথা পিতার প্রতি ছেলের কর্তব্য কি , স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক দায়িত্ব সুরা নিসা, সূরা আল ফুরক্বান, মুমিনূনে ঈমানদারদের গুণাবলী আর মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্পর্কে সূরা আল-হুযরাতে আলেচিত হয়েছে। এছাড়াও কুরআনে আমছাল ও কাসাস তথা ইউসুফ –,যুলায়খা, নুহ ও তার স্ত্রী ,ফেরাউন ও মুসা, আদ-সামুদ সহ অনেক ব্যাক্তি ও গোত্রের উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। এছাড়াও হুকুমাত তথা সার্বভৌমত্ব কার? আইন কার? এতে শিক্ষা নীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধনীতি সব কিছুরই মৌলিক দিকনির্দেশনা আছে।
এখন কথা হচ্ছে কুরআন এসব বিষয় আলোচনার উদ্দেশ্য কি? শুধুমাত্র ফযীলতের উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত কিংবা পানি পড়ার কাজে ব্যবহার করার জন্য এসেছে? এর জবাবও কুরআনে আছে।
কুরআন বলছে – ইত্তাবিয়ু মা উনযিলা ইলাইকা- আমি আপনার প্রতি যা নাজিল করেছি তার অনুসরণ কর। এই কারণে হযরত আয়েশা (রা) বলেেেছন আল্লাহর রাসুল হচ্ছেন জীবন্ত কুরআন। এতে যেসব বিধান আছে তা এসেছে বিচার ফায়সালার জন্য-লিতাহকুমা বাইনানন্নাস। আর অতীত জাতির যেসব ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে তা নিছক ইতহাস শোনার জন্য নয় তা হচ্ছে- লা ইবরাতান লি উলিল আবসার তথা দুরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের জন্য উপদেশ স্বরুপ । আর আল্লাহর সৃষ্টিরাজির বর্ণণা এসেছে লিইয়াদ্দাব্বারু আয়াতিহি তথা আল্লাহর এসব নিদর্শন দেখে তাদাব্বুর – তাফাক্কুর, গভীর চিন্তা ভাবনা করার জন্য।
কুরআনের শিক্ষা
সীরু ফীল আরদ-তোমরা পৃথিীবীতে ভ্রমন কর’
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষা ভ্রমন: তাৎপর্য ও করণীয়
قد خلت من قبلكم سنن- فسيروا في الارض فانظروا كيف كان عاقبة المكذبين-هذا بيان للناس وهدي و موعظة للمتقين- ال عمران ১৩৭-১৩৮
ان في خلق السموات والارض واختلاف الليل وانهار لايت لاولي الالباب- الذين يذكرون الله قياما وقعودا وعلي جنوبهم ويتفكرون في خلق السموات والارض- ربنا ماخلقت هذا باطلا- سبحنك فقنا عذاب االنار- ربنا انك من تدخل النار فقد اخزيته- وما للظلمين من انصار- ال عمران ১৯০-১৯২
সন্মানিত সভাপতি , মেহমানবৃন্দ ও প্রিয় ডেলিগেট ভাই-বোনেরা
আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ। আমাকে কনফারেন্স ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে সীরু ফীল আরদ- তোমরা পৃথিীবীতে ভ্রমন কর’ এই আয়াতের তাৎপর্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করতে বলা হয়েছে । আমি পঠিত কুরআনের আয়াতগুলোর আলোকে দুই ভাগে আলোচনা করতে চাই।
ক্স ১. ইসলামের দৃষ্টিতে পৃথিবী ভ্রমনের উদ্দেশ্য ও ফায়দা
ক্স ২. ভ্রমন কালীন সময়ে আমরা কি করতে পারি
ইসলামের দৃষ্টিতে পৃথিবী ভ্রমনের উদ্দেশ্য ও ফায়দা
প্রিয় ডেলিগেট ভাই ও বোনেরা! আসুন এখন আমরা সীরু ফীল আরদ তথা তোমরা পৃথিীবী ভ্রমন কর আল্লাহর এই নির্দেশের তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করি। আল্লাহ তাআলা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় পৃথিবী ভ্রমনের কথা বলেছেন। এই প্রসংগে আল্লা¬াহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
قد خلت من قبلكم سنن- فسيروا في الارض فانظروا كيف كان عاقبة المكذبين – هذا بيان للناس وهدي و موعظة للمتقين- ال عمران ১৩৭-১৩৮
অর্থাৎ তোমাদের আগে অনেক যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে। পৃথিবীতে ঘোরা ফেরা করে দেখে নাও যারা ( আল্লাহর বিধান ও হেদায়াতকে) মিথ্যা বলেছে তাদের পরিণাম কি হয়েছে। এটি মানব জাতির জন্য একটি সুস্পষ্ট সতর্কবাণী এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশ ( সূরা আল-ইমরান ১৩৭-১৩৮।)
এই আয়াত থেকে জানা গেল যে মাঝে মধ্যে পৃথিবী ভ্রমন করাও ইবাদ হতে পারে যদি কেউ আল্লাহর নির্দেশ
বাস্তবায়নের জন্য পৃথিবী ভ্রমন করে। আর আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়নের নামই হচ্ছে ইবাদত। তাহলে পৃথিবী ভ্রমন করেও সওয়াব হাসিল সম্ভব হতে পারে যদি আল্লাহর সৃষ্টিরাজি দেখে আল্লাহর শোকর জার বান্দা হওয়ার উদ্দেশ্যে কেউ ভ্রমন করে। নিছক হলিডে উদযাপন কিংবা দেশ ভ্রমন আর শিক্ষা ভ্রমননের মধ্যে পার্থক্য এখানেই যে সখের বশবর্তী হয়ে নিছক দেশ দেখা বা হলিডে করার মধ্যে শেখার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকেনা । আর শিক্ষা ভ্রমনের মধ্যে শিক্ষা লাভের জন্যই ভ্রমন হয়। আর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যেই দেখা হয়। কুরআনের উপরি উল্লেখিত আয়াত সহ কুরআন-সুন্নাহর অনেক বানী থেকে এটা প্রমানিত যে মাঝে মধ্যে ’শিক্ষা ভ্রমন’ শুধু বৈধ নয় এটা প্রয়োজনও বটে।
কুরআনে বর্ণিত পৃথিবী ভ্রমনের উদ্দেশ্য ও ফায়দা
প্রিয় ভাই ও বোনেরা! এখন আমি কুরআনে বর্ণিত পৃথিবী ভ্রমনের উদ্দেশ্য ও ফায়দা সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই । এই প্রসংগে কুরআনের একটি আয়াত উল্লেখ করছি:
افلم يسيروا في الارض فينظروا كيف كان عاقبة الذين من قبلهم- دمر الله عليهم وللكفرين امثالها- ذلك بان الله مولي الذين امنوا وان الكفرين لا مولي لهم- محمد ১০-১১
তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমন করেনি অতপর দেখেনি যে তাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কি হয়েছে? আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং কাফেরদের অবস্থা এইরুপই হবে। এটা এজন্য যে আল্লাহ মুমীনদেও হিতৈষী বন্ধু এবং কাফেরদেও কোন হিতৈষী বন্ধু নয়। ( মুহাম্মদ: ১০-১১) মুফতী শফী বলেন এই আয়াতে মক্কার কাফেরদেও বলা হয়েছে পূর্ববর্তী উম্মতদেও উপর যেমনি আযাব এসেছে তেমনি তোমাদের উপরও আসতে পারে।
১. উপরি উল্লেখিত প্রথম আয়াত থেকে জানা যায় পৃথিবী ভ্রমনের মাধ্যমে অতীতে যারা আল্লাহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে তাদের পরিণতি কি হয়েছে তা অনুভব করা যায়। সূরা মুহাম্মদ থেকে উদ্ধৃত আয়াত থেকে জানা যায় পৃথিবী ভ্রমনের মাধ্যমে অতীত জাতি সমূহের পরিণাম সম্পর্কে জানা যায়।
গতবার যারা ইতালীর শিক্ষা ভ্রমন শেষে…………………জায়গায় গিয়েছিলেন তাঁরা কিছু ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন। এই ধ্বংসাবশেষ হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ অমান্যের লোমশিহরণকারী চিত্র। মিশরের নীল নদের তীরে দাঁড়ালে আপনার মনে ভেসে উঠবে আল্লাহ প্রচন্ড প্রতাপশালী ফেরাউনকে কিভাবে ধ্বংস করেছেন। সৌদী আরবের মুযদালিফার প্রান্তরে গেলে আপনার মনে ভেসে উঠবে আল্লাহর ঘর ধ্বংস করতে এসে আবরাহার বাহিণী ক্ষুদ্র পাখির প্রস্তরাঘাতে কিভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। যে আল্লাহ অতীতে এসব সীমালংঘনকারীকে শাস্তি দিয়েছেন তিনি এখনও শাস্তি দিতে সক্ষম। তিনি সীমালংঘনকারীদেরকে দুনিয়াতে শাস্তি দিবেন না আখিরাতে শান্তি দিবেন না দুনিয়া ও আখিরাত উভয় স্থানেই শাস্তি দিবেন এটা তাঁর সিদ্বান্তের ব্যাপার।
২. পৃথিবী ভ্রমনের মাধ্যমে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। এই প্রসংগে আল্ল¬¬াহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
افلم يسيروا في الارض فتكون لهم قلوب يعقلون بها اة اذان يسمعون بها- فانها لاتعمي الابصار ولكن تعمي القلوب التي في الصدور
অর্থাৎ তারা কি এই উদ্দেশ্যে দেশভ্রমন করেনি, যাতে তারা সমঝদার হ্রদয় ও শ্রবণশক্তি সম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারে? বস্তুত চক্ষুতো অন্ধ হয়না, কিন্তু বক্ষস্থিত অন্তরই অন্ধ হয়- সূরা হজ্জ ৪৬।
এই আয়াতের তাফসীরে মূফতী শফী (রহ) লেখেন: ’’অতীতকাল ও অতীত জাতিসমূহের অবস্থা সরে যমীনে প্রত্যক্ষ করলে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। তবে শর্ত এই যে, এসব অবস্থা শুধু ঐতিহাসিক দৃষ্টিভংগীতে নয়; শিক্ষাগ্রহনের দৃষ্টিভংগীতেও দেখতে হবে। ইবনে আবী হাতেম কিতাবুত্তাফাক্কুরে মালেক ইবনে দীনার থেকে বর্ণনা করেন: আল¬াহ তায়ালা মূসা (আ:)কে আদেশ দেন যে, লোহার জুতা ও লোহার লাঠি তৈরী কর এবং আল¬াহর পৃথিবীতে এত ঘোরাফেরা কর যে, লোহার জুতা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যায় এবং লোহার লাঠি ভেংগে যায়্- রুহুল মায়ানী। এই রেওয়ায়েতটি বিশুদ্ধ হলে এই ভ্রমন ও পর্যটনের উদ্দেশ্যন জ্ঞান ও চক্ষুষ্মানতা অর্জন করা বৈ কিছু নয়’’
মাওলানা মওদুদী কুরআনে যেসব স্থানের কথা উল্লেখ আছে সেসব স্থান দেখার জন্য ভ্রমন করেছেন- কুরআনের দেশে মাওলানা মওদূদী নামে বাংলা ভাষায় বইটি প্রকাশিত হয়েছে।
৩. মুসলমানদের অতীতের পর্যালোচনা করে বর্তমানের করণীয় ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা করা সম্ভব হয়। স্পেনের কর্ডোভা, গ্রানাডা ও জিব্রাল্টার ভ্রমন করলে আপনার মনে ভেসে উঠবে স্পেনে মুসলিম শাসনের কথা। ভেসে উঠবে তারিক বিন যিয়াদের কথা।
স্পেনের মুসলমানদের একে অপরের সাথে ঝগড় বিবাদ, র্পপরের মাল লুন্ঠন , খুন খারাবী, পরাস্পরিক অনৈক্যে ছিল। আর শাসকরা ছিল বিলাসিতায় লিপ্ত। এমনি নাজুক অবস্থায় মুসলমানদের একটি অংশ কর্তৃক শত্র“দের সহযোগিতা দানের কারণেই স্পেনে মুসলমানদের পতন হয়। মুসলমনদের মধ্যে আত্মপূজা ও আত্মপ্রীতি কাজ করছিল। তাদের শত্র“রা তাদের ঘরে ঢুকে পড়লেও তাদের মধ্যে ইসলামী ¯প্রীট ছিলনা। । বরং প্রবৃত্তির পূজা ও বস্তুবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এই কারণেই মুসলমানরা আস্তে আস্তে স্পেনের সালতানাত হারায়।
আপনি যদি দামেশক যান তাহলে দেখবেন অনেক বড় বড় ইসলামী স্কলারের অতীত অবদান। বাগদাদে মুসলমানদের পতনের পর নির্বিচারে মুসলিম নারী পুরুষ হত্যা করা হয়; লাইব্রেরী জ্বালিয়ে দেয়া হয়। অনেক আলেমকে বিতাড়িত করা হয়। এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে মিশর ও দামেশক এর কতিপয় আলেম বৈঠকে মিলিত হন। তাঁরা উপলবদ্ধি করেন যে মুসলমানরা সামরিক দিক থেকে পর্যুদুস্ত। জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে আবার জাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। তাঁরা বড় বড় গ্রন্থ ও বিশ্বকোষ রচনা শুরু করেন। সে সময় দামেশক জ্ঞান চর্চার কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। বাগদাদে তাতারদের আক্রমনে ইসলামী উম্মাহ জ্ঞানের যে সম্পদ হারিয়েছে তার কিছুটা হলেও ক্ষতিপূরণ করতে এসব ইসলামী স্বলারগণ চেষ্টা চালান। তাঁদের চেষ্টায় অনেক মাদ্রাসা ও লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিশাল বিশাল গ্রন্থ রচিত হয়।
৪. বিভিন্ন দেশ ও জাতির ভাষা, কৃষ্টি ও সভ্যতা জানা যায়। একথা আল্লাহ মহাগ্রন্থ আলকুরআনে এভাবে উল্লেখ করেছেন: ومن ايته خلق السموات والارض واختلاف السنتكم والوانكم- ان في ذلك لايت للعالمين আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। নিশ্চয়ই এর মধ্যে জ্ঞানী ব্যক্তিদের জন্য নিদর্শন রয়েছে- সূরা রূম ২২। ]
দেখুন আমরা যারা এখানে আছি আমাদের ভাষার মধ্যে কত বৈচিত্র রয়েছ। আমাদের একজনের চেহারার সাথে আরেকজনের চেহারার মিল নেই। আমাদের চেহারার এই অমিল- আমাদের ভাষার পার্থ্যক্য আল্লাহর কুদরাতের নিদর্শন। আর এই পার্থক্য সত্বেও আমাদের মধ্যে যে ব্রাদারহুড, সিস্টারহুড ও মানবতাবোধ রয়েছে তা আল্লাহর আরেক নিয়ামত। যখন মানব সম্প্রদায় ভাষা ও বণর্েূর পার্থ্যক্য সত্বেও একে অপরের সুখে দুখে অংশ গ্রহন করে; একে অপরের সাথে ভাই-ভাই হিসাবে আচরণ করে; সবাই মিলে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে তখন মানব সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা , জাস্টিস থাকে। কেউ নিছক একই ভাষা-ভাষী হওয়ার কারণে অপর ভাষা-ভাষী বা একই বর্ণের হওয়ার কারণে অপর বর্ণের উপর জুলম করেনা। আর যখন ন্যায়- অন্যায় বিচার বিবেবচনা না করে নিছক ভাষা ও বর্ণের ভিত্তিতে মানুষের সম্পর্ক নির্ণিত হয় তখন মানব সমাজে অশান্তি দেখা যায়।
ভ্রমনের মাধ্যমে নানা ধরনের ভাষা-ভাষী ও বর্ণের মানুষের পরস্পরের দেখা সাক্ষাতের মাধ্যমে আমরা এই মেসেজ ছড়িয়ে দিতে পারি, ’’ আমরা বিভিণœ ভাষা-ভাষী ও বর্ণের মানুষ হতে পারি কিন্তু আমরা সকলেই এক আদমের
সন্তান। আমরা জুলম নির্যাতনের বিরুদ্ধে ও মানব কল্যানে এক সাথে ভূমিকা রাখতে পারি। আর আমরা যারা একই কালেমায় বিশ্বাসী; একই নবীর আদর্শের পতাকাবাহী , একই কিবলার দিকে নামায পড়ি, একই কুরআন তিলাওয়াত করি। আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করতে পারি। বিভিণœ মাযহাবের অনুসারী হতে পারি। কিন্তু মাযহাবী গোঁড়ামী, ফেরকাবাজি, ফতোয়াবাজি ছেড়ে কালেমার মূলমন্ত্রের ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহর বুহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ ভূামকা পালন করতে পারি।
দাওয়াত ইলাল্লাহ
৫. প্রিয় ভাই ও বোনেরা! এক দেশ থেকে আরেক দেশ ভ্রমনের মাধ্যমে ঐ দেশের মানুষের চাল চলন, সভ্যতা, সংস্কৃতি উপলব্ধি করা যায়। তাদের উথ্যান পতনের অনেক অজানা কাহিনী সংশ্লিষ্ট দেশের ঐতিহাসিক স্থান সমূহ ও মিউজিয়াম দেখে জানা সম্ভব হয়; তাদের ইতিবাচক ও নেতিবাচক গুণাবলী সমূহ উপলব্ধি করা সম্ভব হয়। এসব কিছু দেখে আমরা আমাদের দাওয়াতী কাজের কৌশল পর্যালোচনা করতে পারি। আমরা যে ইউরোপে অবস্থান করছি সে ইউরোপের কৃষ্টি কালচার ভালভাবে উপলব্ধি না করে তাদের মাঝে উত্তম কৌশলে দাওয়াতী কাজ করা সম্ভব নয়। আর ভ্রমনের সময় চলাফেরা, উঠাবসা, খাওয়া-দাওয়া তথা আমাদেও সামগ্রিক আচার-আচরণের মাধ্যমেও আমরা দাওয়াতী কাজ করতে পারি। হাসানুল বান্না বলেছিলেন, আমি যখন বাসে উঠি তখন আমি দায়ী। আমি যখন ট্রেনি উঠি তখন আমি দায়ী। আমি যখন উড়োজাজে চলি তখন আমি। আমি শুধু আমার এলাকায় দায়ী নই। আমি যখন যেখানে চলি সেখানেই দায়ী।
৬. ভ্রমনের সময় পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে যে সম্পর্ক গড়ে উঠে এর মাধ্যমে ভাল বন্ধু সংগ্রহ করা যায়। বিশেষত আমাদের ছেলে-মেয়েরা তারা বিভিন্ন দেশের সমবয়সীদের সাথে ফ্রেন্ডশীপ গড়ার সুযোগ পায়।
একজন মানুষের জীবনে ভাল বন্ধুত্বের বিরাট প্রভাব রয়েছে। অনেক মানুষ ভাল বন্ধুর সংশ্রবে এসে ভাল হয়ে যায়। আর অনেকই খারাপ বন্ধুর সংশ্রবে এসে মদ, জুয়া খেলে সর্বস্ব হারিয়ে ভিক্ষুকে পরিণত হয়। এই প্রসংগে একটি হাদীস উলে¬খ করছি:
عن ابي موسي قال قال رسول الله صلي الله عليه وسلم مثل الجليس الصالح والسوء كحامل المسك ونافخ الكير فحامل المسك اما ان يحذيك واما ان تبتاع منه واما ان تجد منه ريحا طيبة ونافخ الكير اما ان يحرق ثيابك واما ان تجد ريحا خبيثة
হযরত আবু মূরা আশয়ারী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসুলে কারীম সাল¬াল-াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেছেন: সৎ সংগী ও অসৎ সংগীর উদাহরণ হচ্ছে মূশক আম্বরের বাহক এবং কামারের উত্তাপক যন্ত্রের ন্যায়। মিশম্বরের বাহক হয়তো তোমাদের কিছু দিবে অথবা তোমরা তার থেকে খরিদ করবে অথবা অন্তত তোমরা তার থেকে সুঘ্রান পাবে। কিন্তু কামারের উত্তাপক যন্ত্র হয়তো তোমাদের কাপড় জ্বালিয়ে দেবে নয়তো নোংরা গন্ধে মেজাজ খারাপ করে দিবে- বুখারী ও মুসলিম।
আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে যারা বন্ধুত্ব গড়ে, ব্রাসারহুড বা সিস্টারহুড এর সুমুধুর সম্পর্ক গড়ে উঠে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদেরকে আরশের ছায়াতলে স্থান দিবেন।
৭. প্রিয় ভাই ও বোনেরা! ভ্রমনের মাধ্যমে মনের হক আদায় করা সম্ভব হয়; নানা কিছু দেখে মন প্রফুল্ল থাকে। আল্লাহর রাসুল ( সা) বলেছেন ওয়া ইন্না লিজাসাদিকা আলাইকা হাক্কুন; ওয়া ইন্না লিযাওযিকা আলাইকা হাক্কুন ও লি আহলিকা আলাইকা হাক্কুন- অর্থাৎ তোমার শরীরেরও হক আছে। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি র্পস্পরের হক রয়েছে। পরিবারের সদস্য একে অপরের প্রতি একে অপরের হক রয়েছ। অধীন্তদের প্রতি উর্ধতন ব্যক্তিদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর হক আদায় করার পাশাপাশি এসব হকও আদায় করা প্রয়োজন।
আমরা জানি শরীর ও মনের সমন্বয়েই একজন মানুষ । তাই শরীরের হক তথা খাওয়া-বিশ্রাম প্রভৃতি আদায় করার পাশাপাশি মনের হকও আদায় করতে হয়। মনের দুই ধরনের হক রয়েছে: প্রথমত মনের শান্তির জন্য মনকে আল্ল¬াহর যিকির- আযাকারে লিপ্ত রাখতে হয়। এতে মন শক্তিশালী হয়। দ্বিতীয়ত:মনের কিছু চাহিদা আছে- তা পূরণ করতে হয়। তবে মনের সব চাহিদা বৈধ নয়। যেমন কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় যেসব কামনা মনে জাগ্রত হয় তা পুরন করা থেকে দূরে থাকতে হয়। কিন্তু মনের বৈধ চাহিদা পুরণ করার চেষ্টা করতে হবে; তাহলেই মন খুশী থাকে। মন খুশী থাকলেই সব কাজ খুশী মনে করা যায়। আর মন অখুশী থাকলে কোন কাজই ঠিকমত করা সম্ভব হয়না।
একেকজন মানুষের মন একেক কারণে খুশী হয়। মনের খুশী ব্যাক্তির মন মননের উপর নির্ভরশীল। সংস্কৃতি প্রেমিক মানুষেরা গান, নাটক উপভোগ করতে ভালবাসেন। কেউ কেউ ভ্রমনে আবার কেউ কারো সাথে মিশে আনন্দ পান। কেউ ফুল বাগানে ফুলের সুন্দর সমাহার ও মধুর সুঘ্রাণ উপভোগ কওে আনন্দ পান। আল্ল¬াহর রাসুল সাল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম সাহাবাদের সাথে মাঝে মধ্যে কৌাতুক কওে আনন্দ উপভোগ করতেন। অবশ্য তিনি কৌতুকের জন্য আলাদা অনুষ্ঠান করার প্রমান নেই। তবে কথা বার্তার মধ্যেই কৌতুক করতেন। এ প্রসংগে অনেক হাদীস আছে। হযরত আয়েশা (রা) বলেন,একবার আমার গৃহে আল্ল¬াহর রাসুল সাল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্লম আগমন করেন। সে সময় আমার কাছ্ েএক বৃদ্বা বসা ছিল। তিনি জানতে চান তোমার কাছে কে? আমি বললাম আমার এক খালা। তখন আল¬াহর রাসুল বললেন জান্নাতে কোন বৃদ্ধা যাবেনা। একথা শোনার পর বৃদ্ধা বিষন্ন হয়ে গেল। তখন রাসুলুল¬াহ (স) তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন,বৃদ্ধারা যখন জান্নাতে যাবে,তখন বৃদ্ধা থাকবেনা বরং যুবতী হয়ে যাবে। একথা শোনার পর বৃদ্ধার মুখে হাসি দেখ দিল। আরেকবার আল¬াহর রাসুল সাল-াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম সাহাবাদের সাথে খেজুর খাচ্ছিলেন। খাওয়ারর সময় আল¬াহর রাসুল (স) খেজুরের বিচি গুলো হযরত আলীর পাশে রেখে দেন; ফলে তাঁর পাশে কোন বিচি ছিলনা। খাবার শেষে তিনি সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, দেখ দেখ আলী কি পেটুক সে কত খেজুর খেয়েছে? একথার উত্তরে আলী (রা) বললেন, ’’ আমার শশুর কি পেটুক তিনি খেজুরের বীচি সহ খেয়ে ফেলেছেন’’। এ থেকে বুঝা যায় বৈধ সীমা রেখার মধ্যে মাঝে মধ্যে মনের আনন্দ দায়ক কিছু করা প্রয়োজন।
অধিক পরিশ্রম করতে হলে শারীরিক শক্তির পাশাপাশি মানসিক শক্তি প্রয়োজন। আর এটা মনের আনন্দের উপর নির্ভরশীল। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনকে আনন্দিত রাখার চেষ্টা করা উচিত। তাহলেই জীবনে অনেক কিছু করা সম্ভব। এই প্রসংগে আল¬াহর রাসুল সাল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম ইরশাদ করেছেন: روحوا القلوب ساعة وساعة‘ فا ن القلوب اذا وكلت عميت কাজের ফাঁকে মনকে আনন্দ দেবে, তা না হলে মন যদি পরিশ্রান্ত হয়ে যায় তবে মন অন্ধ হয়ে যাবে । মানসিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য মাঝে মধ্যে অককাশ যাপন করা যায়। উন্নত বিশ্বের সরকার প্রধানসহ গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিরা বছরে একাধিকবার অবকাশ যাপন করতে যান। এরফলে রাষ্ট্রীয় রুটিন দায়িত্বের ঝামেলামুক্ত হয়ে নিরিবিলি চিন্তা করার সুযোগ পান। অবকাশ যাপন থেকে ফিরে এসে নতুন উদ্যমে কাজ করার শক্তি পান।
ভ্রমন কালীন সময়ে আমরা কি করতে পারি
প্রিয় ভাই ও বোনেরা! ইতিপূর্বে পৃথিবী ভ্রমনের উদ্দেশ্য ও ফায়দা সম্পর্কে আলোচনা প্রসংগে করণীয় সম্পর্কে কিছু কথা চলে এসেছে। ভ্রমন কালীন সময়ে আমরা আর কি করতে পারি এই প্রসংগে সূরা আল ইমরানের ১৯০-১৯১ আয়াতের নির্দেশনা আপনাদের সামনে পেশ করতে চাই। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করছেন:
ان في خلق السموات والارض واختلاف الليل وانهار لايت لاولي الالباب- الذين يذكرون الله قياما وقعودا وعلي جنوبهم ويتفكرون في خلق السموات والارض
পৃথিবী ও আকাশের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের পালাক্রমে যাওয়া আসার মধ্যে যে সমস্ত বুদ্ধিমান লোক উঠতে, বসতে, ও শয়নে সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ ও পৃথিবীর গঠনাকৃতি নিয়ে চিন্তা- ভাবনা করে তাদের জন্য রয়েছে বহুতর নিদর্শন’’ ।
বুদ্ধিমান ব্যক্তির লক্ষণ
মুফতী শফী (রহ) এই আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে লিখেন বুদ্ধিমান বলতে কাদেরকে বুঝায়? বিশ্বের প্রতিটি মানুষই নিজেদেরকে বুদ্ধিমান বলে দাবী করে। কোন একজন নির্বোধ ব্যক্তিও নিজেকে নির্বোধ বলে স্বীকার করেনা। যার কারণে কুরআনে বুদ্ধিমানের কয়েকটি লক্ষণ বাতলে দিয়েছে:
প্রথম লক্ষনটি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা। আমরা সাধারনত জ্ঞান, নাক, চোখ, জিহবা প্রভৃতি অংগ প্রত্যংগের মাধ্যমে জ্ঞান লাভ করি। নির্বোধ প্রাণীর মধ্যেও এসব রয়েছে। পক্ষান্তরে বুদ্ধির কাজ হলো লক্ষ্যনীয় নিদর্শনাদির মধ্য থেকে গৃহীত দলীল-প্রমানের মাধ্যমে এমন কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যা অনুভব যোগ্য নয় এবং যার দ্বারা বাস্তবতার সর্বশেষ উৎকর্ষ লাভ করতে পারে। এই মূলনীতির প্রেক্ষিতে আসমান, জমীন এবং এর অন্তর্গত যাবতীয় সৃষ্টির ও সেগুলোর সামগ্রীর পরিচালনার দিকে লক্ষ্য করলে এটা প্রমানিত হয় যে এই বিশ্ব একজন স্রষ্টা বিশেষ হেকমতের দ্বারা তৈরী করেছেন এবং তাঁর ইচ্ছায়ই সমগ্র ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হচ্ছে। বস্তুত সে সত্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা। আসমান যমীনের ব্যবস্থাপনার দিকে দৃষ্টি করলেই আল্লাহর পরিচয় মিলে। যে ব্যক্তি এ পরিচয় লাভ করতে পারেনা সে বুদ্ধিমান লোক নয়।
বর্তমানে আমরা দেখি বিজ্ঞানীরা আগুণ, পানি ও বাষ্পকে বিদ্যুত তৈরীর প্রকৃত শক্তি মনে করে। কিন্তু বুদ্ধিমান ব্যক্তি উপলবদ্ধি করতে পারে যে আসল শক্তি অগুণ, পানি বা বায়ুর নয় আসল শক্তি তাঁর হাতে ন্যান্ত যিনি এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন।
অর্থাৎ একজন বুদ্ধিজীবির পরিচয় প্রসংগে দুইটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন: ১. আল্লাহর সৃষ্টি রাজি দেখা ও এ সম্পর্কে চিন্তা গবেষনা করা ২. এসব দেখে মুখে আল্লাহর যিকির , আযকার, তাসবীহ ও তাহলীল করাা এবং আল্লাহর কথা স্মরণে রেখে দুনিয়ার সকল কাজ করা।
উল্লেখিত আয়াত সমুহের আলোকে আসুন আমরা আমাদের করণীয় জেনে নিই:
১. আমাদের প্রথম করণীয় হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি নিদর্শন সমূহ নয়ন ভরে দেখা । নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর সৃষ্টি সৌন্দর্য দেখা ও উপভোগ করা ইবাদত হতে পারে যদি আমরা আল্লাহর নির্দোশ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে দেখি এবং উপভোগ করি। এই প্রসংগে একটি হাদীস পেশ করছি:
عن علي ان النبي صلي الله عليه وسلم كان اذا قام من اليل يتسوك ثم ينظر الي السماء زيقول: ان في خلق السموات والارض واختلاف الليل وانهار لايت لاولي الالباب
রাসুলে কারীম (সা) প্রতি রাতে যখন তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য উঠতেন তখন মেসওয়াক করতেন এবং আসমানের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতেন। অতপর কুরআনের এই আয়াত তিলাওয়াত করতেন।
আব্দুল্লাহ ইবন উমর একবার হযরত আয়েশা (রা) কে প্রশ্ন করেন আমাকে রাসুলে কারীম (সা) এর খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আপনি দেখেছেন তা বর্ণনা করূন। হযরত আয়েশা জবাব দিলেন আল্লাহর রাসুলের সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ। এর পর তিনি এক রাতের ঘটনা বর্ণনা করেন। হযরত অয়েশা বললেন রাসুলে কারীম (সা) একরাতে আমার বিছানায় এসে শোয়ার পর হে আয়েশা তুমি কি আজ রাত আল্লাহর ইবাদতে সময় কাটানোর জন্য আমাকে অনুমতি দিবে। তখন তিনি বললেন হে আল্লাহর রাসুল আমি আপনাকে ভালবাসি এবং আপনি যা করতে চান তা সম্পন্ন করতে সহযোগিতা করতে ভালবাসি। এরপর আল্লাহর রাসুল অজু করলেন তারপর দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লেন অতপর কুরআন তিলাওয়াত শুরু করলেন। এরপর হাত উত্তোলন করে কান্না শুরু করলেন। হযরত আয়েশা বলেন ’ আমি দেখেছি তাঁর কান্নায় জমীন ভিজে গেছে। সকাল বেলা বেলাল ফজরের অযান দেয়ার জন্য এসে দেখলেন আল্লাহর রাসুল কাঁদছেন। তখন বেলাল বললেন হে আল্লাহর রাসূল আপনি কাঁদছেন অথচ আল্লাহ ঘোষনা করেছেন আপনার কোন পাপ নেই। সব কিছুই মাফ করে দিয়েছেন। আপনি নি®আপ। তারপর রাসুলে কারীম (সা) বললেন, ’ হে বেলাল আমি কি আল্লাহর শোকর গুযার বান্দা হবনা? তিনি আরও বললেন আমি কেন কান্না করবোনা আল্লাহ তাআলা আজ রাতে এই আয়াত নাযিল করেছেন। (ان في خلق السموات والارض واختلاف الليل وانهار لايت لاولي الالباب ) অতপর তিনি বললেন সে ব্যক্তি ধ্বংস হোক যে এই আয়াত তিলাওয়াত করলো অথচ এর উপর চিন্তা ভাবনা করলেনা। ( তাফসীর কবীর, ৫ম খন্ড , পৃ ১৩৯)
এই তিনটি নিদর্শন ছাড়াও সূরা আল বাক্কারার ১৬৪ নম্বর অয়াতে আরও ৫টি নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে।
আল্লাহ ইরশাদ করছেন:
ان في خلق السموات والارض واختلاف الليل والنهار والفلك التي تجري في البحر بما ينفع الناس و ما انزل الله من السماء من ماء فاحيا به الارض بعد موتها-و بث فيها من كل دابة وتصريف الرياح والسحاب المسخر بين السماء والارض لايت لقوم يعقلون- البقرة ১৬৪
( এই নিখিল জাহানের একক সম্্রাট যে আল্লাহ তাআলা, তার নিদর্শনসমূহ বিদ্যমান রয়েছে) এই আসমান যমীনের সৃষ্টি রহস্যেও মাঝে। ( চেয়ে দেখো) রাত দিনের এই আবর্তনের নিয়মনীতি, মহাসাগওে ভাসমান জাহাজ সমূহ- যা মানুষের জন্য কল্যানকর দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে ঘুওে বেড়ায়। ( লক্ষ্য করো) আল্লাহ তায়ালার বর্ষনকরা বৃষ্টির পানির মাঝে ( কিভাবে) নির্জীব ভূমিকে তিনি এ পানি দ্বারা নতুন জীবন দান করেন। অতপর (সেই নব জীবন প্রাপ্ত ) এই ভূখন্ডে হাজারো ধরনের প্রাণীর আবির্ভাব ঘটান। ( এই প্রাণীকুলের জীবন ধারনের জন্য আসমান যমীনের মাঝে) নিজস্ব নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থায় মেঘমালার প্রবাহ সৃষ্টি করেন। ( মূলত এই বিশ্ব নিখিলের বিশাল কারখানাতে এবং এর প্রতি পদে রয়েছে) সুস্থ বিবেকবান মানুষের জন্য জীবনন্ত নিদর্শন। যারা ( সত্যিকারভাবে সব কিছুর মর্মাথ্য) অনুধাবন করার চেষ্টা করে।আল বাক্কারা ১৬৪
সাইয়েদ কুতুব বলেন, ’আল্লাহর সৃষ্টিরাজির দিকে সুক্ষদৃষ্টি দিয়ে তাকালে আমরা দেখতো পাব যে এসব কিছুর মাধ্যমে কুরআন মজীদ আল্লাহর অস্তিত্ব ও শক্তি ক্ষমতার নিদর্শনগুলো আমাদের দৃষ্টির সামনে ফুটিয়ে তুলছে। আমাদেও অনূভূতিকে প্রচন্ডভাবে ঝাঁকিয়ে তুলছে; জীবন্ত করছে মৃত হ্রদয়কে। প্রথম দৃষ্টিতে দেখি সাধারনভাবে এরপর যত দেখি তত বেশীই এসব কিছুর গুপ্ত রহস্য আমাদের চোখের সামনে ভাসতে থাকে। এই যে বহু নক্ষত্রে ভরা গ্রহরাজি যা নিজ নিজ কক্ষপথে শুন্যলোকে অবিরাম ঘুরে বেড়ায়। এগুলোর বিশালত্ব অনুধাবন করতে না পারলেও, এসব কিছুর মধ্যে অবস্থিত গুপ্ত রহস্য ভান্ডার উদঘাটন করতে না পারলেও আল্লাহ পাক তাঁর কোন কোন বান্দাহকে এসব কিছু সম্পর্কে কিছু জ্ঞান দান করেন- যখন তারা এগুলো সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করে।
তিনি আরও বলেন, রাত ও দিনের অবর্তন এর অর্থ হচ্ছে আঁধারের পিছনে আলোর আগমন। অর্থাৎ সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত। এগুলোর দিকে তাকালে চেতনার মধ্যে বিপ্লব সৃষ্টি হয় কত জনের সামনে প্রকাশিত হয় আশ্চর্যজনক অনেক রহস্য। মুমিনের অন্তর ক্রমান্বয়ে এসব দৃশ্য থেকে আরও নতুন নতুন তথ্য পায়। এসব কিছু আল্লাহকে বেশী বেশী স্মরণ করতে সাহায্য করে এবং প্রতিবারেই সে নতুন কিছু সৃষ্টির সন্ধান পায়।
সাইয়েদ কুতুব আরও বলেন, সাগরের বুকে যে সব জাহাজ চলে- এই আযাতের উপর গভীলভাবে দৃষ্টিপাত কওে আমি যে জিনিসটি বুঝতে পেরেছি তা যেন বাস্তবে সর্বত্র প্রত্যক্ষ করছি। আমার নজরে পড়ে মহাসাগরের বুকে আমরা যখন জাহাজে কওে পাড়ি জমাই তখন সেই নৌযানটিকে এই বিশাল সাগওে তুলনায় একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র বিন্দু সম মনে হয়। আমরা দেখি ঐ মহাসাগর আমাদেরকে তার বুকে কেমন কওে ধারণ কওে দেশ থেকে দেশান্তওে নিয়ে যায়। ঐ জাহাজে করে পাড়ি জমানোর সময় আমি দেখি আমাদের চতুর্দিকে পবর্তসম উত্তাল তরংগ দেখি। কোন মহান সত্তা এই তরংগমালার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে গন্তব্যস্থানে নিয়ে যান। এটা আল্লাহ পাকের অমোঘ নিদর্শনের একটি যে তিনি আমাদেরকে উত্তাল তরংগের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েও ক্ষুদ্র নৌযানে করে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দেন।
আকাশ থেকে পানি বর্ষন, পৃথিবীর নানা কিছু মরে যাওয়ার পর আবার জিন্দা করা এবং বায়ুর পরিবর্তন ও মেঘ মালার নিয়ন্ত্রনের মধ্যে চোখ খুলে দেয়ার মত আশ্চর্য দৃশ্য রয়েছে। এসকল দৃশ্যের দিকে খোলা হ্রদয় নিয়ে চিন্তা করার জন্য এবং উন্মুক্ত দৃষ্টিদিয়ে বিশ্বপ্রকৃতির দৃশ্যাবলী দেখার জন্য তিনি মুমিনকে আহবান জানিয়েছেন।
আল্লাহ পাক কিভাবে বৃষ্টির পানি দ্বারা শুকনা নির্জীব জমীন সজীব করেন এবং বীজ ও আঁটির মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেন। এসব কিছু দেখে নাস্তিকেরা আল্লাহর অস্তিত্বেও স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় নেই। তবুও তারা এসব কিছু থেকে মানুষের দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করছে। তারা মনে করে সব ক্ষমতার মালিক একজনকেই মানতে হবে এমন কোন কথা নেই। রুশ পন্ডিতগন দীর্ঘদিন মানুষকে ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছেন যে তারা জীবন সৃষ্টির কাছাকাছি চলে গেছেন। সৃষ্টিকর্তও প্রয়োজন নাই। কিন্তু অবশেষে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে জীব সৃষ্টি কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়।
এবার একটু বায় প্রবাহের দিকে দৃষ্টি করূন কিভাবে বায় প্রবাহ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে প্রবাহিত হয় এবং তার উপর মেঘমালা আলোর ঝাঁকের মত ভেসে বেড়াচ্ছে। আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে এ মেঘমালা যেন বন্দী হয়ে আছে। আফসোসের বিশষয় হচ্ছে রহস্যভরা পৃথিবী বক্ষে এত সুষমা থাকার পরও অনেক জ্যেতিহীন চোখ আছে যা এসব দেখতে পায়না-বহু ব্যক্তি এমন আছে যাদেও ভোতা হ্রদয় সমূহ এগুলো হ্রদয়ংগম করতে পারেনা। যার কারণে তারা বিশ্বজাহানে অবস্থিত আল্লাহ পাকের একত্ব ঘোষনাকারী নিদর্শনাবলী দেখা থেকে বঞ্চিত থাকে। ( ফী যিলাল আল কুরআন, সূরা বাকারা ১৬৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর)
মুফতী শফী (রহ) লেখেন, আসমান যমীনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের বিবর্তন তাঁরই ক্ষমতার পরিপূর্ণতা ও একত্ববাদের প্রকৃত প্রমান। তেমনিভাবে পানির উপর নৌকা ও জাহাজ তথা জলযানসমূহের চলাচলও একটি বিরাট প্রমান। পানিকে আল্লাহ তাআলা এমন তরল পদার্থ কওে সৃষ্টি করেছেন যে একান্ত তরল ও প্রবাহমান হওয়া সত্বেও তার পিঠের উপর লক্ষ লক্ষ মন ও ওজন বিশিষ্ট বিশালাকার জাহাজ বিরাট ওজনের চাপ নিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলাচল করে। তদুপুরি এগুলোকে গতিশিল করার জন্য বাতাসের গতি ও নিতান্ত রহস্যপূর্ণভাবে সে গতির পরিবর্তন করতে থাকা প্রভৃতি বিষয়ও এদিকে ইংগিত করে যে এগুলোর সৃষ্টি ও পরিচালনার পিছনে এক মহাবিজ্ঞ সত্তা বিদ্যমান। পানীয় পদার্থগুলো তরল না হলে যেমন একাজটি সম্ভব হতোনা। তেমনি বাতাসের মাঝে গতি সৃষ্টি না হলেও জাহাজ চলতে পারতোনা। এগুলোর পক্ষে দুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করা সম্ভব হতোনা। এ বিষয়টি কুরআনে এভাবে উল্লেখ আছে:
ان يشا يسكن الرياح فيظللن رواكد علي ظهره
অর্থাৎ আল্লাহ ইচ্ছা করলে বাতাসের গতিকে স্তব্ধ কওে দিতে পারেনবেং তখন এ সমস্ত জাহাজ সাগর পৃষ্ঠে ঠায় দাঁড়িয়ে যাবে।
অনুরপভাবে আকাশ থেকে পানিকে বিন্দু বিন্দু করে বর্ষন করা যাতে কোন ক্ষতি সাধিত না হয়। যদি এ পানি প্লাবনের আকাওে আসতো তাহলে কোন মানুষ জীব জন্তু কিংবা অন্যান্য জিনিসপত্র কিছুই থাকতোনা। অতপর পানি বর্ষনের পর ভূপুষ্টে তাকে সংরক্ষন করা মানুষের সাধ্যায়ত্ব ব্যাপার ছিল। যদি মানুষকে বলা হতো তোমাদেও প্রয়োজনমত তোমরা সংরক্ষন কওে রাখ তাহলে মানুষের জন্য সম্ভব হতোনা। আল্লাহ তাআলা পানিকে ভূমিতে ধারণ করিয়েছেন। পুকুর, কল থেকে পানি উত্তোলন করা যায়। আবার কোথাও সাগর দিয়েছেন আর কোথাও তুষারের আকারে সংরক্ষন করে রেখেছেন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে পানি নিংশেষ করে দিতে পারতেন। ( و انا علي ذهاب به لقدرون – বৃষ্টির পানি পড়ার পর তাকে প্রবাহিত কওে নিংশেষ কওে দেয়ার ক্ষমতা আমার ছিল)। ( মাআরেফ আল কুরআন, সূরা আল বাক্বারার ১৬৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর)।
উল্লেখিত আলোচনার মাধ্যমে এই কথা আপনাদের সামনে স্পষ্ট করতে চেয়েছি যে আমাদেরকে সব সময় বিশেষত পৃথিবী ভ্রমনকালে কুরআনে উল্লেখিত বুদ্ধিজীবির দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহর সৃষ্টিরাজি দেখতে হবে।
خلق السموات والارض واختلاف الليل وانهار لايت لاولي الالباب
মাওলানা মওদূদী এই আয়াতের তাফসীরে বলেন প্রত্যেক ব্যক্তি বিশ্বজাহানের নিদর্শন সমূহ বিবেক-বুদ্ধিহীন যেন জন্তু জানোয়ারের দৃষ্টিতে না দেখে গভীর নীরীক্ষা ও পর্যবেক্ষনের দৃষ্টিতে দেখে ও সে সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করে। তাহলে প্রতিটি নিদর্শনের সাহায্যে অতি সহজে যথার্থ ও চূড়ান্ত সত্যের দ্বারে পৌঁছতে পারে। (মওদুদী ১৯৯৬: ৮৮ তাফহীম, ২য় খন্ড ) মওদূদী আরও বলেন বিশ্ব জাহানের দিকে গভীল দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করার পর এসত্য পুরোপুরি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এটি একটি জ্ঞানগর্ভ ব্যবস্থাপনা।
আফসোসের বিষয় হচ্ছে আজকের সমাজে এমন কিছু বুদ্বিজীবি রয়েছেন যারা আল্লাহর সৃষ্টিরাজি দেখেন সত্য কিন্তু তাদের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের সময় আল্লাহর প্রশংসাকীর্তন থাকেনা-নিছক জাগতিক রুপ রসে ভরা থাকে। বস্তুগত দৃষ্টিকোণ কিংবা নিছক মনোরঞ্জনের জন্য এসব সৃষ্টির রুপ সৌন্দর্য প্রকাশ করেন। নদী, নালা, পাহাড়, পর্বত, গাছ, গাছালী, পাখ-পাখালী এসব যে আল্লাহর কুদরাতের নিদর্শন সে কথা প্রকাশিত হয়না। বরং কেউ কেউ নামে মুসলিম হলেও তাদের লেখণী ও বক্তব্যের বিষয়বস্তু আল্লাহর দ্বীনের বিরোধিতা। এমনকি তাদের কেউ কেউতো আযানের সুমহান আল্লাহু আকবার ধ্বনিকে বেশ্যদের খদ্দরের আহবানের সাথে তুলনা করেছেন। নাউযুবিল্লাহ।
আরও বেদনার বিষয় হচ্ছে কেউ কেউতো আছেন তাঁরা আল্লাহর সৃষ্টিরাজি দেখেন সত্য এসব দেখেও আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেননা। অথচ আল্লাহ যে আছেন তা বলার জন্য নবী রাসূল প্রেরণ প্রয়োজন নেই। আল্লাহর সৃষ্টিরাজির প্রতি তাকালেই আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমান মিলে। এই প্রসংগে একটি হাদীস পেশ করছি:
عن ابي هريرة رضي الله تعالي عنه قال قال رسول الله صلي الله عليه وسلم بينما رجل مستلق علي فراشه اذ رفع راسه فنظر الي النجوم و الي السماء فقال اشهد ان لك ربا وخالقا- اللهم اغفر لي فنظر الله اليه فغفرله- قرطبي- ২-৩১৪
অর্থাৎ হযরত আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসুলে কারীম (সা) বলেন তিনি বিছানায় শোয়া এক ব্যক্তিকে দেখলেন বিছানা থেকে উঠার পর নক্ষত্ররাজি ও আসমানের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে একজন সৃষ্টিকর্তা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অতপর বললো হে আল্লাহ আমাকে মাফ করূন। আল্লাহ তার প্রতি রহমত বর্ষন করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন।
হযরত ইবরাহীম (আ) এর ঘটনা উল্লেখ করা যায়। হযরত ইবরাহীম চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্ররাজি দেখে প্রত্যেকটাকে রব বলে ঘোষনা দিয়ে যখন দেখলেন এসব কিছু অস্তমিত হয়ে যায় তখন উপলবদ্ধি করলেন এসব কিছু রব হতে পারেনা। রব তিনিই যিনি এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন।
ইবন আববাস বর্ণণা করেন যে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার নামায পড়ে তাঁর ঘরে আসতেন এরপর চার রাকাআত নামায আদায় করতেন এবং অতপর ঘুমিয়ে পড়তেন। এরপর মধ্যরাতের কিছুক্ষন আগে বা পরে ঘুম থেকে জাগতেন। ঘুম থেকে জেগে হাত দ্বারা মুখ মুছে নিতেন এবং সুরা আল ইমরাণের শেষ দশ আয়াত তিলাওয়াত করতেন। তারপর মেসওয়াক ও অজু করে দুই রাকাআত করে করে আট রাকাআত নামাজ পড়তেন। এরপর বিতরের নামায আদায় করে আবার ঘুমিয়ে পড়তেন। ফজরের নামাযের আযান দেয়া হলে দুই রাকাআত নামায আদায় করে মসজিদে যেতেন এবং ফজরের নামাজ আদায় করতেন। তিনি কখনও অজু করতেন আবার কখনও অজু করতেননা। কেননা তাঁর চোখ ঘুমালেও তাঁর অন্তর জাগ্রত ছিল। এই কারণে তিনি উপলবদ্ধি করতেন যে অজু ভংগ হওয়ার মত কোন কিছু ঘটেনি। আবার কখনও তিনি গোসল করতেন।
আনন্দের বিষয় হচ্ছে এর পাশাপাশি এমন কিছু বুদ্ধিজীবি, কবি, সাহিত্যিক আছেন যাঁরা নদীর ঢেউয়ের মর্মর ধ্বনি আর পাখির গানের মধ্যেও আল্লাহর গুনগান শুনতে পান। এমনকি জনৈক কবি বলেছেন: ঘরি হারদম বগুইয়াদ আল্লাহু হু- নাটন টন টন না টন টন টন না টুটু। অর্থাৎ ঘরির টন টন নিছক টন টন আওয়ায নয় মূলত ঘরি আল্লাহু আল্লাহু যিকির করছে।
আল্লাহর তাসবীহ করা- রাব্বানা মা খালকতা হাযা বাতিলা; সুবহানাক্বা ফাক্বিনা আযাবান্নার
২. বিশ্ব ব্যবস্থাপনা ও আল্লাহর সৃষ্টিরাজি সম্পর্কে আমরা চিন্তা ভাবনা করলেই আমাদেরকে এই স্বীকৃতি দিতে হবে যে , ’রাব্বানা মাখালকতা হাযা বতিলা’-অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ আপনি এসব বিনা প্রয়োজনে বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেননি। কুরতুবী বলেন এর অর্থ হচ্ছে এতে আপনার কুদরাত এর প্রমান রয়েছে। কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞান এ বিশাল সৃষ্টি জগতের গুড় রহস্য উদঘাটনে অক্ষম। নিজের অক্ষমতার স্বীকৃতি দিয়ে আল্লাহ যে অগনিত নেয়ামতরাজি আমাদেরকে দিয়েছেন এজন্য প্রশংসা করা দরকার। তাঁর তাসবীহ পাঠ করা দরকার। মূলত আমরা আল্লাহর সৃষ্ট যা কিছু দেখছি প্রত্যেক বস্তুই আল্লাহর তাসবীহ করছে। এই প্রসংগে আল্লাহ বলেন:
وان من شئ الايسبح بحمده ولكن لاتفقهون تسبيحهم
অর্থাৎ এমন কোন বস্তু নেই যা আল্লাহর প্রশংসার তাসবীহ পাঠ করেনা কিন্তু তোমরা তাদের তাসবীহ বুঝতে পারনা-
( বনী ইসরাঈল) আল্লাহ আরও বলছেন:
الم تر ان الله يسبح له من في السموات والارض والطير صفت كل قد علم صلاته وتسبيحه والله عليم بما يفعلون
অর্থাৎ তোমরা কি জাননা যে আসমান জমীনে যা কিছু আছে সকলেই আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা ও গুণগান করে, বিশেষত পাখীকুল যারা দুই পাখা বিস্তার করে শুন্যে উড়ে বেড়ায়, তাদের সকলেই স্ব-স্ব দোআ ও তাসবীহ সম্পর্কে জ্ঞান এবং আল্লাহ তাআলাও তাদের তাসবীহ সম্পর্কে খবর রাখেন- সূরা আল-নূর।
রাব্বানা মা খালাকতা হাযা বাতিলা- এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে যারা মনে করেন জগতকে নিয়ে সৃষ্টিকর্তা পাশা খেলছেন তারা বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত। এই প্রসংগে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট বলেছেন-আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিনা যে জগতকে নিয়ে সৃষ্টিকর্তা পাশা খেলেছেন। সূরা দোখানে আল্লাহ উল্লেখ করছেন আমি আকাশ ও তুণমূল এবং তন্মধ্যস্থিত যাবতীয় বস্তু খেলাস্থলে সৃষ্টি করিনি।
৩. যিকরুল্লাহ: আসমান, যমীন ও এর অন্তর্গত যাবতীয় সৃষ্টিরাজি দেখে বুদ্ধিমান ব্যক্তির কাজ হচ্ছে : الذين يذكرون الله قياما وقعودا وعلي جنوبهم বুদ্ধিমান লোক উঠতে, বসতে, ও শয়নে সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করে।
এই আয়াতের তাফসীর প্রসংগে ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী কয়েকটি কথা বলেন:
১. এই আয়াতের আলোকে বুঝা যায় সার্বক্ষনিক আল্লাহর যিকির করা একজন মানষের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিৎ। আর যিকির দ্বারা বুঝানো হয়েছে:
ক. যিকির বিল লিসান তথা মৌখিক যিকির করা। যেমন :
একজন মুমীন সকল কাজ আল্লাহর নামে শুরু করা উচিৎ। যেমন খাওয়া, দাওয়া, বৈঠক পরিচালনা, লেখা কিংবা বক্তব্য শুরু করা ইত্যাদি। এই প্রসংগে রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন
كل امرلايبدا فيه ببسم الله الرحمن الرحيم فهو اجذم- تفسير ابن كثير
অর্থাৎ বিসমিল্লাহ তথা আল্লাহর নাম নেয়া ছাড়া যেই কাজ করা হয় তা বরকত শুন্য থাকে ( তাফসীরে ইবন কাসীর)।
ঘর থেকে সফরে বের হওয়ার সময় পরিবারের সদস্য, আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় এই দোয়া পাঠ করা যায়:
استودع الله دينك وامانتك وخواتيم عملك زودك الله التقوي وغفر ذنبك ويسر لك الخير حيث كنت
ঘর থেকে বের হওয়ার ইচ্ছা করার পর নিন্মের এই দোয়া পাঠ করা উত্তম। কেননা রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ঘর থেকে বাহির হওয়ার ইচ্ছা করলে এই দোয়া পাঠ করতেন।
اللهم اني اعوذ بك من ان اضل او اضل او ازل او ازل او اظلم او اعلم او اجهل او يجهل علي
তারপর ঘর থেকে বাহির হবার সময় পড়তে হয়:
بسم الله توكلت علي الله لاحول ولا قوة الا با لله-
বাহনে চড়ার আগে সমস্যাগ্রস্থ কেউ উপস্থিত থাকলে সাধ্যমত সদকা করা মুস্তাহাব। এরপর ডান পা আগে দিয়ে বাহনে বসতে হয়। বাহনে স্থির হয়ে বসার পর নিম্বের দোয়া পড়া উত্তম।
الله اكبر الله اكبر سبحان الذي سخر لنا هذا وماكناله مقرنين و انا الي ربنا لمنقلبون-
তারপর আল হামদুলিল্লাহ তিনবার অতপর আল্লাহু আকবার তিনবার উচ্চারণ করে নিন্মের দোয়া পাঠ করবে।
سبحانك اللهم اني ظلمت نفسي فاغفرلي فانه لايغفر الذنوب الا انت
উক্ত দোয়ার সাথে নিন্মের দোয়া যোগ করা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমানিত।
اللهم انا نسالك في سفرنا هذا البر والتقوي- و من العمل ماترضيّ اللهم هون علينا سفرنا هذا واطوعنا بعده- اللهم انت الصاحب فر السفر والخليفة في الاهل اللهم اني اعوذبك من وعثاء السفر و كابة المنظر و سوء المنقلب في المال والاهل ولولد- رواه مسلم
ভ্রমনের সময় উঁচু জায়গা অতিক্রম করাকালে তাকবীর এবং নীচু জায়গা অতিক্রম করাকালে তাসবীহ পড়া উত্তম। এ প্রসংগে হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে।
عن جابر ابن عبدالله قال كنا اذا صعدنا كبرناو اذا نزلنا سبحنا—رواه بخاري
হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমরা যখন উঁচু জায়গা অতিক্রম করতাম তখন তাকবীর পড়তাম আর যখন নীচু জায়গা অতিক্রম করতাম তখন তাসবীহ পড়তাম।
আর সফরে সাময়িকভাবে কোন স্থানে অবতরণ করতে হয় সেসময় নীচের দোয়া পড়া উত্তম।
اعوذ بكلمات الله التامات من شر ما خلق فانه لايضره شي حتي يرتحل من منزله ذلك– رواه مسلم
কোন কোন হাদীসে নিন্মের দোয়া পাঠ করার কথা উল্লেখ আছে:
اللهم اني اسالك خيرها وخير اهلها وخير ما فيها‘ واعوذ بك من شرها وشر اهلها وشر ما فيها
সফরের সময় রাত হয়ে গেলে নিন্মের দোয়া পাঠ করা মুস্তাহাব।
اعوذ با لله من شرك وشر ما فيك وشر ما خلق فيك وشر ما يدب عليك عليك
সফরের সময় কোন জাতি বা অন্য কারো দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকলে নিন্মের দোয়া পাঠ করবে:
اللهم انا نجعلك في نحورهم ونعوذ بك من شرورهم
যে কোন ধরনের বিপদ মুসীবতের সন্মুখীণ হলে নিন্মের দোয়া পাঠ করবে:
لااله الاالله العظيم الحليم‘ لا اله الا اله رب العرش العظيم‘ لااله الا الله رب السموات ورب الارض ورب العرش الكريم
তিরমিযি শরীফে হযরত আনাস থেকে একটি হাদীস বর্ণিত আছে যে রাসুলে কারীম সালআল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেকোন বিপদ মুসীবতের সময় নিন্মের দোয়া পাঠ করতেন:
يا حي يا قيوم برحمتك استغيث
এভাবে পুরো সফরে অমরা উঠতে বসতে চলতে ফিরতে মাসনূন দোয়া পাঠ করতে পারি।
উল্লেখ্য যে সকল নেক আমলই গুরুত্বসহ পালন করার চেষ্টা করা উচিৎ। কোন নেক আমলকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এই প্রসংগে একটি হাদীস উল্লেখ যোগ্য:
عن ابي ذر رضي الله تعالي عنه قال قال النبي صلي الله عليه وسلم لاتحقرن من المعروف شيئا ولو ان تلقي اخاك بوجه طلق- ( مسلم)
হযরত আবু যর (রা) হতে বর্ণিত তিনি বলেন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন: নেকীর কোন কাজকে নগন্য মনে করোনা। যদিও নেকীর কাজটি এমন হয় যে তুমি অপর ভাইর সাথে হাসি মুখে মিলিত হও। ( মুসলিম)
এই হাদীস থেকে জানা যায় যে নেকীর কাজ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হলেও তা গুরুত্বের সাথে করা দরকার। কেননা আমরা জানি না আল্লাহ আমাদের কোন আমলে বেশী খুশী হন। অতএব মাসনূন যিকির আযাকার জানা ও তা পড়ার চেষ্টা করা উচিৎ। তবে মৌখিক যিকির করার জন্য বিদআতী কোন পন্থা অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে তিনি বলেন রাসুলে কারীম (সা) বলেন: তোমরা বেশী পরিমানে লাইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ কর এবং এস্তগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা কর। ইবলীস বলে আমি মানুষকে গুনাহে লিপ্ত কওে ধ্বংস করেছি। প্রত্যুত্তওে তারা কালোমা লাইলাহা পাঠ কওে আমাকে ধ্বংস করেছে। এই অবস্থা দেখে আমি তাদেরকে এমন অসার কল্পনার অনুসারী করে দিয়েছি যে যা তারা সৎকাজ মনে করে সম্পন্ন করে ( যেমন সাধারনত বিদআত সমূহের অবস্থা) এতে করে তাদের তাওবা করারও তাওফিক হয়না।
খ. যিকির বিল জাওয়ারিহ: আল্লাহ তায়ালা এই আযাতে দাঁড়ানো, বসা ও শোয়া অবস্থায় যিকির করার কথা বলে অংগজদ প্রত্যংগের যিকিরের কথা বলেছেন। এই আয়াতের ভিত্তিতে কোন কোন ফকীহ বলেন এই আয়াতে নামাজ পড়ার তিনি অবস্থার কথা উল্লেখ আছে। সক্ষম ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে হয়: দাঁড়াতে সক্ষম না হলে বসে নামাজ পড়তে হয়। আর বসে সক্ষম না হলেশু শুয়ে নামাজ পড়তে হবে। এক্ষেত্রে ডান কাত হয়ে নামাজ পড়ার কথা বলা হয়েছে। কেউ যদি ডান কাত হয়ে নামাজ পড়তে না পারেন তিনি যেভাবে সম্ভব সেভাবে নামাজ আদায় করবেন।
এই আয়াতের অর্থ হচ্ছে আমরা শুধু মৌখিক যেকির করলাম কিন্তু বাস্তব জীবনে যিকিরের মধ্যে উচ্চারিত কথাগুলোর বিপরীত আমল করলাম তা একজন মুমীনের বৈশিষ্ট্য নয়। এজন মুমীনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুখে যা স্কীকৃতি দিবে বাস্তব জীবনে তা বাস্তবায়ন করবে।
গ. যিকির বিল ক্বালব: যিকির বিল ক্বালবই হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে তাফাক্কুর তথা চিন্তা ভাবনা করা। ইমাম রাযী বলছেন চিন্তা ভাবনা- ফিকর ছাড়া কোন যিকিরই পূর্ণাংগ হতে পারেনা। এই কারণে আমাদেও দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে তাফাক্কুর ও তাদাব্বুর করা।
৪. এই আয়াত থেকে বুঝা যায় তাদাববুর ও তাফাক্কুর করা আমাদের মৌলিক কাজ। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা মহাগ্রন্থ আল কুরআন শুধু তিলাওয়াত করার জন্য নাযিল করেননি। কুরআনের প্রতিটি বর্ণ তিলাওয়াত করলে কম পক্ষে দশ নেকী পাওয়া যাবে। কিন্তু শুধু নেকী গননার জন্য কুরআন নাযিল হয়নি। কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই কুরআন আমরা পড়ব ও সে অনুযায়ী জীবন গড়ব; অন্যকে শেখাবো এবং কুরআনের বিধি বিধান নিয়ে চিন্তা গবেষনা করবো। এই প্রসংগে আল্লাহ বলেন:
افلا يتد برون القران ام علي قلوب اقفالها-محمد ২৪
অর্থাৎ তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীল চিন্তা করেনা। না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ- মুহাম্মদ ২৪
কুরআন নিয়ে চিন্তা গবেষনা, আল্লাহর সৃষ্টিরাজি নিয়ে ভাবনা বিরাট ইবাদত। এই প্রসংগে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন:
قال رسول الله صلي الله عليه وسلم لا عبادة كتفكر
অর্থাৎ তাফাক্কুর তথা চিন্তা গবেষনার মত ইবাদত হয়না। তিনি আরও বলেন:
تفكر ساعة خير من عبادة سنة
অর্থাৎ এক ঘন্টা তাফাক্কুর করা এক বছর অন্য নফল ইবাদত করার চেয়ে উত্তম।
ইবন মুসাইয়্যেব বলেন শুধু যোহর ও আসর নামাজ ইবাদত নয়। ইবাদত হচ্ছে আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা থেকে বিরত থাকা ও আল্লাহর নির্দেশাবলী স্পর্কে তাফাক্কুর করা।
হযরত হাসান বলেন এক ঘন্টা তাফাক্কুর করা সারা রাত ইবাদত করার চেয়ে উত্তম। সার কথা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি ও সৃষ্ট জগতের উপর চিন্তা-গবেষনা করে তার মহাত্ম ও কুদরাত সম্পর্কে অবগত হওয়া একটি মহৎ উচ্চ পর্যায়ের এবাদত। সেগুলোর মধ্যে গভীর মনোনিবেশ করে তা থেকে শিক্ষা গ্রহন না করা একান্তই নির্বুদ্ধিতা।
দ্বীনের জ্ঞান গবেষনায় সময় ব্যয় করা নফল ইবাদত বন্দেগীর চেয়ে উত্তম। কেননা নফল ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে একজন ব্যক্তির অত্মিক উন্নতি হয় আর জ্ঞান গবেষনার মাধ্যমে সমাজের অনেক মানুষ উপকৃত হয়। অপরদিকে দ্বীনের সহীহ ইলম ছাড়া সঠিকভাবে দ্বীন পালন সম্ভব নয়। তাই ইসলাম দ্বীনের ইলম অর্জন করার প্রতি উৎসাহিত করেছে। এ প্রসংগে অনেক হাদীস রয়েছে: عن ابن عباس قال تدارس العلم ساعة من الليل خير من احياءها- رواه الدارمي হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন রাতে এক ঘন্টা দ্বীন সম্পর্কে অধ্যয়ন সারা রাত নফল ইবাদত চেয়ে উত্তম – দারেমী । আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, فقيه واحد اشد علي الشيطان من الف عابد- رواه الترمذي এই আদীস থেকে বুঝা যায় একজন ফকীহ শয়তানী চক্রান্ত মোকাবিলায় এক হাজার আবেদের চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
তাফাক্কুরের কয়েকটি বিষয়
১. খালকুল্লাহ- আল্লাহর সৃষ্ট রাজি: রাসুলে কারীম (সা) ইরশাদ করছেন:
تفكروا في الخلق ولا تتفكروا في الخالق
অর্থাৎ তোমরা সৃষ্টিরাজি নিয়ে গবেষনা কর কিন্তু সৃষ্টিকর্তা নিয়ে গবেষনা করোনা। ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি বলছেন এর কারণ হচ্ছে সৃষ্টিরাজির ধরন, প্রকৃতি, আকৃতি প্রভৃতি সম্পর্কে গবেষনা করা সম্ভব। কিন্তু সৃষ্টি কর্তার গঠন প্রকৃতি তাঁর জন্য যেমন শোভনীয় তেমনিই অছেন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়না। এ নিয়ে গবেণা করতে গিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভবানা রয়েছে। তাই আমাদেরকে সৃষ্টিরাজি সম্পর্কে তাফাক্কুর ও তাদাব্বুর করতে হবে। সৃষ্টিরাজি সম্পর্কে গবেষনা করতে গেলে অনেক বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে। যেমন:
ক. একজন মানুষ গাছের একটি পাতা নিয়ে চিন্তা করলে তার কাছে ফুটে উঠবে যে পাতায় অনেক ছোট ছোট রেখা আছে। কিছু রেখা স্পষ্ট ও কিছু রেখা এত সুক্ষ ও অস্পষ্ট যে খোলা চোখে তা দেখা যায়না। সেই পাতাটি গ্রহ নক্ষত্রের তুলনায় কিছুই নয়। একজন মানুষ হাতে পাতাটি নিয়ে সুক্ষ ভাবে দেখেও যা তার নজওে আসেনা আল্লাহ পাক যিনি পাতাটি সৃষ্টি করেছেন তাঁর নজরে সব কিছুই রয়েছে। এই ধরনের চিন্তা করার পর কোন একজন মানুষের পক্ষে কখনও পাপ কাজ করা
আতœ পর্যালোচনা:
قال الحسن: الفكرة مراة المومن ينظرفيها الي حسناته وسئاته- ومما يتفكر فيه مخاوف الاخرة من الحشر والنشر والجنة ونعيمها والنار وعذابها-
হযরত হাসান বলেন চিন্তা ভাবনা ( রিপলেকশান) হচ্ছে মানুষের আয়না। এর মাধ্যমে মানুষ তার ভাল-মন্দ দেখতে পায়। আর এই চিন্তার সময় আখিরাতের ভয়, হাশর, জান্নাতের সুখ ও জাহান্নামের আযাবের কথা মনে দোলা দেয়।
হযরত আবু সুলাইমান আল দারেণী এক রাতে অজু করার জন্য পানির পাত্র হাতে নেন। সে রাতে তাঁর কাছে একজন মেহমান ছিল। মেহমান দেখলেন যে তিনি রাতে যে পানির পাত্রে আংগুল ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেণ এবং ফজরের নামাজ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকলেন। ফজরের সময় মেহমান তাঁকে প্রশ্ন করলেন হে আবু সুলাইমান তোমার কি হয়েছে? তখন তিনি বললেন আমি পানির পাত্রে হাত দেয়ার পর কিয়ামতের দিন আমার অবস্থা কি হবে এ নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করি এবং সকাল পর্যন্ত অস্থিও হয়ে চিন্তা করতে থাকি। ইবন আতিয়া বলেন এটা ভয়ের চূড়ান্ত পর্যায়। তবে সর্বোত্তম হচ্ছে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা। সুফীদের মতে তাফক্কুর নফল নামাজের চেয়ে উত্তম। তবে ফকীহদেও মতে নামাজই উত্তম। কেননা এতে দোআ আছে।
খ. শারীরিক গঠন: : لقد خلقنا الانسان في احسن تقويم আমিতো মানুষকে সুন্দরতম গঠনে সৃষ্টি করেছি। কোন মানুষের শরীরের কাঠামোতে ভারসাম্য না থাকলে তাকে অসুস্থ মানুষ বলা হয়।
গ. মেধা: প্রত্যেক মানুষের মধ্যে মেধা লুকায়িত আছে। এ প্রসংগে আল্লা¬াহর রাসুল সাল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম বলেছেন: الناس معادن كمعادن الذهب والفضة অর্থাৎ মানুষ স্বর্ণ ও রূপার খনির ন্যায়। তবে স্বর্ণ ও রুপার খনির মধ্যে যেমনি তারতম্য আছে অনুরপভাবে সকল মানুষের প্রতিভার মধ্যেও তারতম্য আছে। একারণে সকলের সৃজন ক্ষমতা সমান নয়। স্বর্ণ ও রুপার খনি কাজে না লাগিয়ে মাটি চাপা দিয়ে রাখলে মানুষ ’’খনির অস্তিত্ব’’ সম্পর্কে জানতে পারেনা। অনুরপভাবে প্রত্যেকের মধ্যে যে প্রতিভা লুকায়িত রয়েছে তা কাজে না লাগালে প্রতিভার অস্তিত্ব বুঝা যায়না । যারা প্রতিভা কাজে লাগান তাঁরাই প্রতিভাধর হিসাবে যশস্বী হন।
ঘ. আসমান ও জমীনের সৃষ্টি রহস্য।
আল¬াহ অন্যত্র বলেন: والفجر- وليال عشر- والشفع والوتر- واليل اذا بسر- هل في ذلك قسم لذي حجر ফজরের কসম, দশটি রাতের, জোড় ও বেজোড়ের এবং রাতের কসম যখন তা বিদায় নিতে থাকে। এর মধ্যে কোন বৃদ্ধিমানের জন্য কি কোন কসম আছে? – সূরা আল ফজর ১-৫। আল¬াহ পাক আরও বলেন: وهو الذي جعل اليل والنهار خلفة لمن اراد ان يذكر او اراد شكورا যারা অনুসন্ধানপ্রিয় অথবা যারা কৃতজ্ঞতাপ্রিয় তাদের জন্য তিনি রাত্রি ও দিনকে সৃষ্টি করেছেন পরিবর্তনশীলনরুপে- সূরা আল ফুরক্বান ৬২।
ঙ. প্রাকৃতিক সম্পদ: আল্লাহ পৃথিবীর সকল কিছুই মানুষের কল্যানে সৃষ্টি করেছেন। এই প্রসংগে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন: هو الذي خلق لكم ما في الارض جميعا অর্থাৎ: তিনিই পৃথিবীতে তোমাদের জন্য সমস্ত জিনিস সৃষ্টি করেছেন’’ । এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে আল্লাহ পাক পৃথিবীর সমস্ত কিছু মানবতার কলানে সৃষ্টি করেছেন। এমনকি বাহ্য দৃষ্টিতে ক্ষতিকর প্রাণীও মানুষের কল্যানে সৃষ্টি করা হয়েছে । এসব কিছু মানব কল্যানে ব্যবহার করতে হলে ব্যবহার করার মত যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকতে হবে।
আল্লাহ পৃথিবীতে অনেক সম্পদ দিয়েছেন। মুসলিম দেশ সমূহেও তেল, খনিজ পদার্থ, তুলা , স্বর্ন সহ অনেক সম্পদ রয়েছে। বাংলাদেশেও সম্পদের অভাব নেই। অভাব হচ্ছে সত ও যোগ্য নেতৃত্ব। প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করার মত প্রযুক্তি থাকলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ ও মাছ সম্পদ কাজে লাগিয়ে আমরা অনেক উন্নতি লাভ করতে পারতাম। বাংলাদেশের রাঙামাটিতে অনেক ফল পঁচে যায়; চাপাই নবাবগঞ্জের আম আন্তর্জাতিক বাজারজাতকরন এখনও সম্ভব হয়নি। তেল ও গ্যাস কাজে লাগানোর মত প্রযুক্তি আমাদের হাতে নেই ; বিদেশের বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে। নদ- নদীতে প্রচুর মাছ আছে। তার সুষ্ঠ ব্যবহার সম্ভব হচ্ছেনা। এইভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় পাশ্চাত্য তাদের সম্পদকে যেভাবে কাজে লাগাতে সক্ষম সে তুলনায় আমরা আমাদের মানব সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগাতে পারছিনা।
লন্ডন শহরের কোথাও কোথাও থেমস নদীর তলদেশে আন্ডার গ্রাউন্ড রেল পথ আছে; কিছু কিছু স্থানে রাস্তার নীচে আন্ডার গ্রাইন্ড রেলপথ , উপরে ব্রীজ আর ব্রীজের উপর অফিস ও প্রাসাদ দেখা যায়। অর্থাৎ একটু জায়গা ( আন্ডার গ্রাইন্ড, নদী হিসাবে নৌয়ান চলাচলে ব্যবহার, ব্রীজ ও প্রসাদ নির্মান করে) নানা কাজে ব্যবহার করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে। আমাদের দেশেও প্রচুর জায়গা আছে; প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব সম্পদ আছে। আমাদের মানব সম্পদকে বোঝা মনে না করে সৎ, যোগ্য ও দক্ষ রুপে গড়ে তোলে আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে যেতো। তাই বর্তমান তরূন প্রজন্মকে আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক সম্পদ কাজে লাগানোর মত যোগ্য হতে হবে। এই জন্য আসমান ও জমীনের সৃষ্টিতত্ব ও প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে গবেষনা করতে হবে।
চ. খাদ্য সামগ্রী:
فلينظر الانسان الي طعامه- انا صببنا الماء صبا- ثم شققنا الارض شقا- فا نبتنا فيها
ছ সমুদ্রকে আয়ত্তাধীন করে দিয়েছেন
الله الذي سخر لكم البحر لتجري الفلك فيه بامره ولتبتغوا من فضله ولعلكم تشكرون- وسخر لكم ما في السموات وما في الارض جميعا منه- ان في ذلك لايت لقوم يتفكرون-
তিনি আল্লাহ যিনি সমুদ্রকে তোমাদের উপকারার্থে আয়ত্তাধীন করে দিয়েছেন, যাতে তাঁর অদেশক্রমে তাতে জাহাজ চলাচল কওে এবং যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ তালাশ কর এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। এবং আয়ত্তাধীন কওে দিয়েছেন তোমাদের যা আছে নভোমন্ডলে ও যা আছে ভূমন্ডলে; তাঁর পক্ষ থেকে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে- আল জাসিয়া ১২-১৩।
জ. পানি ও ফসলাদি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা
افرايتم ماتزرعون- ءانتم تزرعونه ام نحن الزارعون
افرايتم الماء الذي تشربون- ءانتم انزلتموه من المزن ام نحن المنزلون
ঈমানদারদের প্রতি আল্লাহর সতর্কতা
১. কাফেরদের বিত্ত, বৈভব, বিলাসবহুলতা এবং নিজেদের আর্থিক দীনতা যেন বিভ্রান্ত না করে। আল্লাহর রাসূলের কাছে মুসলমানেরা বললো যে কাফেরদেও কত ব্যবসাক্ষানিজ্য, ধন সম্পদ রয়েছে এবং যমীনে তারা দাপট দেখায়- নির্যাতন চালায়। আর আমরা ক্ষুধার তাড়নায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি। মুসলমানদেও এই ধরনের মানসিক অবস্থার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা এই আয়াত নাজিল করেন: لايغرنك تقلب الذين كفروا في البلاد- متاع قليل- ثم ماويهم جهنم وبئس المهاد হে নবী দুনিয়ার বিভিণœ দেশে কাফেরদেও চলা ফেরা যেন তোমাকে ধোকায় ফেলে না দেয়। এটা নিছক কয়েকদিনের জীবনে সামান্য আনন্দ ফুর্তি মাত্র। তারপর এরা সবাই জাহান্নামে চলে যাবে। যা সব চেয়ে খারাপ স্থান। আলে ইমরান ১৯৬-১৯৭
অন্যান্য জাতির ভোগ বিলাস ধেকে হা হুতাশ না করা। এই প্রসংগে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন: ولاتمدن عيتيك الي ما متعنا به ازواجا منهم زهرة الحيوة الدنيا لنفتنهم فيه ورزق ربك خير وابقيذ وامر اهلك بالضلوة واصطبر عليها لانسئلك رزقا نحن نرزقك والعاقبة للتقوي- ’’আর এই কাফেরদের মধ্যে যেসব লোকদের পরীক্ষার সন্মুখীন করার জন্য আমরা বৈষযকি সম্পদের চাকচিক্য দান করেছি- তুমি সে দিকে চোখ তোলে তাকাবেনা। তোমার প্রভুর রেযেক অধিক উত্তম এবং এর ওপর অবিচল থাক। আমরা তোমার কাছে রেযেকে চাচ্ছিনা। আমরাই তোমাকে রেযেক দান করেছি। আর পরিণামে তাকওয়ারই কল্যাণ হয়ে থাকে’’ সূরা তাহা: ১৩১-১৩২
আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার উদাহরণ হচ্ছে অথৈ পানিতে আংগুলের এক ফোটা পানির মত। অপর হাদীসে আছে দুনিয়া কাফেরদের জন্য বেহেশত ও মুমিনদের জন্য জেলখানার মত।
এ ক্ষেত্রে করণীয়
১. সবর করতে হবে। সবর সম্পর্কে কুরতুবী বলেন- নেক কাজ করতে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে। নামায ঠিক মত আদায় করতে হবে।
২. ইসলাম বিরোধীদের বাধা , নির্যাতন ও চারিদিক থেকে কঠিন অবস্থা মনে হলে ধৈর্যেও সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। রাসুলে কারীম (সা) বলেন, ’ইনতিযার আল ফারায বি আল সবর ইবাদাতুন- অর্থাৎ কঠিন অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার সময় পযন্ত অপেক্ষা করা ইবাদত।
৩. হকের খেদমাত করার জন্য উঠে পড়ে লাগা।
আল্লাহ বলছেন:
يا ايها الذين امنوا اصبروا وصابروا ورابطوا- واتقوالله لعلكم تفلدون
হে ঈমানদারগণ সবরের পথ অবলম্বন করো, বতিলপন্থীদেও মোকাবিলায় দৃঢ়তা দেখাও। হকের খেদমত করার জন্য ঋঠে পড়ে লাগো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আশাকরা যায় তোমরা সফলকাম হবে। আলে-ইমরান ২০০।
মাওলানা মওদূদী (রহ) বলেন এই আয়াতে সাবিরূ এর দুইটি অর্থ হয়। ১. কাফেরেরা কুফরীর ব্যাপাওে যে দৃঢ়তা, অবিচলতা দেখাচ্ছে এবং কুফরীর ঝান্ডা সমুন্নত রাখার জন্য যে ধরনের চেষ্টা করছে তোমরা তাদেও মোকাবিলায় তাদেও চাইতেও বেশী দৃঢ়তা, অবিচলতা ও মজবুতি দেখাও। দুই. তাদেও মোকাবিলায় দৃঢ়তা, অবিছরতা ও মজুবুতি দেখানোর ব্যাপাওে তোমরা পরস্পর প্রতিযোগিতা করো।
৯. দোয়া: পুরো সফরে নিজের জন্য, পিতা মাতা, স্ত্রী ,ছেলে সন্তান ,আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী ও মুসলিম উম্মাহর জন্যবেশী বেশী করে দোয়া করা সুন্নাত। কেননা সফরের সময় দোয়া বেশী কবুল হয়। এ প্রসংগে একটি হাদীস উল্লেখ করছি।
عن ابي هريرة عن النبي صلي الله عليه و سلم قال- ثلاث دعوات مستجانات لاشك فيهن- دعوة المظلوم و – دعوة المسافر و دعوة الوالد علي ولده- رواه الترمذي و ابن ماجة
হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, তিন ধরণের দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। মাযলুমের দোয়া, মুসাফির অবস্থায় যে দোয়া করা হয় এবং পিতা মাতার দোয়া ছেলে সন্তানের জন্য। (তিরমিযি ও ইবনে মাযা )
১০. সফরের আমীর বানানো ও শৃংখলা রক্ষা। গ্র“প ভিত্তিক সফর করলে নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে সফরের দায়িত্বশীল বানানো দরকার। কেননা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : اذا كانوا ثلثة فليومروا احدهم অর্থাৎ তারা তিন জন হলেও একজনকে আমীর বানানো উচিৎ। সফরের সময় শৃংখলা বিধানের জন্য এটা জরুরী। এ থেকে আরেকটি শিক্ষা পাওয়া যায় যে মুসলমানেরা সব সময় সংঘবদ্ধ জীবন যাপন করা উচিৎ। সফরের সময় একাকী কোথাও যাওয়া ঠিক নয়। কোথাও যেতে হলে কাউকে সংগে নেয়া উত্তম। একাকী সফর করলে বিপদ আপদে সাহায্য করার মত কেউ থাকেনা। সফরের সময় কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে গ্র“পের অন্যদেরকে জানিয়ে যাওয়া দরকার। অনেক সময় দেখা যায় এক জনের জন্য পুরো গ্র“পকে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। পথে কারো কোন কিছুর প্রয়োজন হলে যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত সময়ে তা সম্পন্ন করা ভাল। অন্য সংগী সাথীদের যেন কষ্ট না হয় সে দিক্ েলক্ষ্য রাখতে হবে। সফরের সময় খুব বেশী খাওযা দাওয়া করা থেকে বিরত থাকতে হয়। কেননা অতি ভোজন অনেক সময় পীড়ার কারণ হয়। গরমের সময বেশী বেশী পানি পান করা ভাল। প্রয়োজনে হালকা কিছু খাবার সাথে রাখা যায়। কেননা অনেক সময় খুব বেশী ক্ষুধা লাগলে রুচি সন্মত খাবার পাওয়া যায়না। সফরের সময় সংগী সাথীসহ সকলের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা দরকার। কারো সাথে কোন কিছু নিয়ে ঝগড়া বিবাদ করা উচিৎ নয়। কেউ খারাপ আচরন কররেও তার সাথে ভাল আচরন করতে হয়। সাধ্যমত সংগী সাথীদেরকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করা ভাল।
প্রিয় ডেলিগেট ভাই ও বোনেরা! উপসংহারে বলতে চাই যে কুরআন দিয়ে মুসলমানরা বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেছিল। যে কুরআনের সংস্পর্শ এসে বর্বর আরব সুসভ্য হয়েছিল। যে কুরআনের কথা বাধা দিতে এসে উমর ঈমান এনেছিল এবং পরবর্তীতে খলীফা হয়ে অর্ধ জাহান শাসন করেছিল সে কুরআন আজও আমাদের মাঝে আছে। কিন্তু আজ আমাদের সেই খিলাফত নেই। আমাদের সেই শৌার্য-বীর্য নেই। যেই স্পেন, দামেশক ও বাগদাদ একদিন জ্ঞান বিজ্ঞানের রাজধানী ছিল। বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে জ্ঞান পিপাসুরা ভীড় জমাতো। আজও সেই স্পেন আছে কিন্তু মুসলিম শাসন নেই। আজও সেই বাগদাদ আছে কিন্তু কিভাবে আছে তা আপনাদের সামনে পষ্কিার। এমনি প্রেক্ষাপটে আমাদের এই ভ্রমন হোক আমাদের অতীত পর্যালোচনা, বর্তমানের করণীয় নির্ধারণ ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার এক সন্মিলণ- এই মুনাজাত করেই আমার আলোচনা এখানেই শেষ করছি। হাযা মিন ইনদি ওয়াল ইলমু ইন্দাল্লাহ। আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।