মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানবসভ্যতার গোড়াপত্তন করবেন। সূচনায় তিনি ফেরেশতাদের উদ্দেশে যা বললেন, তা কোরআন মজিদে এভাবে এসেছে: ‘আর যখন আপনার রব ফেরেশতাদের উদ্দেশে বললেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি) পাঠাব।’ (সুরা-২ [৮৭] বাকারা, রুকু: ৪, আয়াত: ৩০)। এই ঘোষণার পর আল্লাহ তাআলা আদি পিতা হজরত ‘আদম’ আলাইহিস সালামকে বানালেন। অতঃপর তাঁর মধ্য থেকে তৈরি করলেন আদি মাতা হজরত ‘হাওয়া’ আলাইহাস সালামকে, যা কোরআনে বিবৃত হয়েছে এভাবে: ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের রবকে ভয় করো, যিনি তোমাদের সৃজন করেছেন এক সত্তা থেকে এবং তা থেকে বানিয়েছেন তাঁর জোড়া এবং বিস্তৃত করেছেন এতদুভয় থেকে বহু নর ও নারী। (সুরা-৪ [৭২] নিসা, রুকু: ১, আয়াত: ১)।
মানবজাতির প্রথম প্রজন্ম আদম-কন্যা হজরত আকলিমা হজরত হাবিল (রা.)-এর স্ত্রী হলেন। (৫: ২৭)। এভাবে মানবসভ্যতার উন্মেষ ঘটল; বিকাশ ঘটল মানবজাতির। পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ হলো সমাজ।
মুসলিম জাতির কিবলা (কেন্দ্রবিন্দু বা প্রাণকেন্দ্র) মক্কা শরিফের কাবা শরিফ, যা বায়তুল্লাহ শরিফ (আল্লাহর ঘর) বা খানায়ে কাবা (কাবা ঘর) নামেও পরিচিত। এর পুনর্নির্মাণ এবং মক্কা সভ্যতার উদ্ভবের সঙ্গেও সংযুক্ত রয়েছে একজন মহীয়সী রমণী নবী পিতা হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সহধর্মিণী ও শিশু নবী হজরত ইসমাইল জাবিহুল্লাহর মাতা হজরত হাজেরা আলাইহাস সালামের অবদান। এ জগতে জান্নাতের নহর ‘জমজম’ কূপের সৃষ্টির সূচনাও তাঁর হাতে। তাঁরই স্মৃতি হজের গুরুত্বপূর্ণ বিধান সফা-মারওয়া সায়ি বা দৌড়ানো; যা কিয়ামত পর্যন্ত সব হাজির জন্য ওয়াজিব। এই ইতিহাসে জড়িয়ে আছেন হজরত ইব্রাহিম-পুত্র নবী হজরত ইসহাক আলাইহিস সালামের মাতা বিবি সারাও।
শিশু নবী হজরত মুসা আলাইহিস সালামের প্রাণ বাঁচিয়েছেন ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া, পরবর্তী সময়ে তিনি হন তাঁর পালক মাতা। কোরআনের বিবরণ: ‘ফেরাউনের স্ত্রী (আছিয়া) বললেন, (এই সন্তান) চক্ষু শীতল করবে আমার ও তোমার। তাকে হত্যা কোরো না; হয়তো সে আমাদের উপকারে আসবে অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপে বরণ করব। তারা (ফলাফল) অবগত ছিল না।’ (সুরা-২৮ [৪৯] কাছাছ, রুকু: ১, আয়াত: ৯)। এই সাগর-ভাসা মুসা আলাইহিস সালামই কালে শ্রেষ্ঠ রাসুল চতুষ্টয়ের একজন হয়েছিলেন। তাঁরই ওপর নাজিল হয়েছিল চারখানা আসমানি বৃহৎ গ্রন্থের অন্যতম ‘তাওরাত’ কিতাব। হজরত মুসা আলাইহিস সালামের জননী ও তাঁর বোনের অবদানের কথাও বর্ণিত হয়েছে কোরআনে। (২০: ৪০, ২৮: ১৩)।
জীবনদায়িনী হজরত আছিয়া আলাইহাস সালাম বিশ্বের সেরা সম্রাট ফারাও ফেরাউনের স্ত্রী হয়েও তওহিদের সত্য বাণী আঁকড়ে ধরে জীবন দিয়ে মানবতার পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তৈরি করে গেছেন অনন্য ইতিহাস এবং তিনি নিজেও একটি উজ্জ্বল ইতিহাস হয়ে আছেন, যা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। ‘আল্লাহ দৃষ্টান্ত পেশ করছেন বিশ্বাসী মোমিনদের জন্য, ফেরাউনের স্ত্রীর। যখন সে (আছিয়া) বলল, হে আমার রব! আপনি আপনার সন্নিধানে আমার জন্য একটি আবাস গৃহ নির্মাণ করুন এবং আমাকে ফেরাউন ও তার অপকর্ম থেকে রেহাই দিন এবং আমাকে জালিম সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা-৬৬ [১০৭] তাহরিম, রুকু: ২, আয়াত: ১১)।
কোরআন মজিদে ‘সুরা আলে ইমরান’ (ইমরান পরিবার) খ্যাত হজরত ইরানের স্ত্রী হান্না অনাগত সন্তানকে মানবকল্যাণে ওয়াক্ফ দান করলেন। যে সন্তানের মাধ্যমে নবী ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন ঘটেছে।
কোরআনের বর্ণনা: ‘যখন বললেন ইমরান-পত্নী, হে আমার প্রভু! নিশ্চয় আমি আমার গর্ভস্থ সন্তানকে (মানবতার জন্য) মুক্ত ঘোষণা করলাম। আপনি আমার তরফ থেকে কবুল করুন, নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা মহাজ্ঞানী। অতঃপর যখন তিনি (হান্না) প্রসব করলেন, (কন্যাসন্তান দেখে) বললেন, হে আমার প্রভু! এ তো আমি কন্যা জন্ম দিলাম! তিনি যা কিছুই প্রসব করেছেন, আল্লাহ তা সম্যক অবগত আছেন। (আল্লাহ জবাবে বলেন) আর নহে কোনো পুত্র এই কন্যার মতো।’ (সুরা-৩ [৮৯ ], রুকু: ৪, আয়াত: ৩৫-৩৬)। ‘আল্লাহ তা চমৎকারভাবে কবুল করলেন এবং তাতে উত্তম শস্য উৎপন্ন করলেন। তাকে লালন করলেন (তার খালু) জাকারিয়া (আ.)। যখনই জাকারিয়া (আ.) তার কাছে সংরক্ষিত কক্ষে প্রবেশ করতেন, তখনই নানান রিজিক আহার্য ও ব্যবহার্য বস্তু দেখতে পেতেন।
তিনি বলেন, হে মরিয়ম! এগুলো তোমার জন্য কোত্থেকে আসে? (মারিয়াম আ.) বলেন, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই তিনি যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিজিক প্রদান করেন। (সুরা-৩ [৮৯], রুকু: ৪, আয়াত: ৩৭)। ‘আর ইমরান-তনয়া মারিয়ামের (উদাহরণ দাও), যিনি নিজেকে পবিত্র রেখেছেন, তাই আমি তাতে আমা হতে রুহু ফুঁকে দিলাম; সে তার রবের বাণীসমূহ সত্যায়ন করেছে এবং তাঁর কিতাব সত্য জেনেছে; সে ছিল অনুগতদের অন্যতম।’ (সুরা-৬৬ [১০৭] তাহরিম, রুকু: ২, আয়াত: ১২)।
সেরা নবী–রাসুলগণের অন্যতম আসমানি চার কিতাবের অন্যতম ইঞ্জিলের অধিকারী মারিয়াম-তনয় হজরত ঈসা আলাইহিস সালাম। তিনি পবিত্র নারীর সন্তান এবং নারী মায়ের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ। তদীয় গ্রন্থেও নারী ও নারীর অধিকার সুরক্ষা বিষয়টি বিধৃত হয়েছে।
কোরআনের ভাষায়: ‘তিনি (হজরত ঈসা আ.) বললেন, আমি আবদুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা), আমাকে কিতাব দেওয়া
হয়েছে এবং আমাকে নবী করা হয়েছে। আর আমাকে বরকতময় করা হয়েছে, যেখানেই আমি থাকব, আমাকে সালাত ও জাকাতের নির্দেশ করা হয়েছে যতকাল আমি বেঁচে থাকব। সর্বোপরি আমাকে মায়ের ভালো ছেলেরূপে পাঠানো হয়েছে; আমাকে রূঢ় দুর্ভাগা করা হয়নি।’ (সুরা-১৯ [৪৪] মারিয়াম, রুকু: ২, আয়াত: ৩০-৩২)।
হয়েছে এবং আমাকে নবী করা হয়েছে। আর আমাকে বরকতময় করা হয়েছে, যেখানেই আমি থাকব, আমাকে সালাত ও জাকাতের নির্দেশ করা হয়েছে যতকাল আমি বেঁচে থাকব। সর্বোপরি আমাকে মায়ের ভালো ছেলেরূপে পাঠানো হয়েছে; আমাকে রূঢ় দুর্ভাগা করা হয়নি।’ (সুরা-১৯ [৪৪] মারিয়াম, রুকু: ২, আয়াত: ৩০-৩২)।
চরম ধৈর্যের পরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে যিনি দুনিয়ায় ধৈর্যের আকররূপে জগৎজোড়া সুখ্যাতি লাভ করেছেন, তিনি নবী হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম। তাঁর জীবনেও সহযোগী ছিলেন একজন হিতৈষী নারী—তাঁর স্ত্রী বিবি রহিমা আলাইহাস সালাম। (৩৮: ৪৪)।
সুন্দর, বিশুদ্ধ ও পবিত্রতম চরিত্রের জন্য জগদ্বিখ্যাত নবী হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাঁরও পার্শ্বচরিত্র ছিল একজন নারী—জুলায়খা, যাঁর মাধ্যমে তাঁর পরিচিতি ও প্রসিদ্ধি ঘটেছে।
সুপ্রসিদ্ধ নবী ও সম্রাট নবী হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের পিতা বিখ্যাত নবী ও সম্রাট হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম। যাঁর প্রতি নাজিল হয়েছে আসমানি কিতাব ‘জাবুর’। তাঁর জীবনেও রয়েছে নারীর প্রভাব ও অবদান। তিনি যখন প্রভুপ্রেমে সংসারবিমুখ হয়ে ইবাদতে ও একাকী ধ্যানে নিমগ্নতায় প্রজা অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার উপক্রম হলেন; তখন তাঁকে নারী উপলক্ষ দিয়ে দায়িত্ব সচেতন ও প্রজামুখী করা হয়। (৩৮: ২১-২৬) (তাফসিরে আজিজি)।
বিখ্যাত নবী ও সম্রাট হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের পুত্র মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাসের নির্মাতা সুপ্রসিদ্ধ নবী ও সম্রাট হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের জীবনেও রয়েছে নারীর ভূমিকা। সাবার সম্রাজ্ঞী রানি বিলকিসের কথাও রয়েছে কোরআন করিমে। (২৭: ২২)। তত্পরবর্তী সময়ে জাদুবিদ্যার প্রভাবকবলিত মিসরের ‘বাবেল’ শহরে প্রেরিত দুজন ফেরেশতার স্খলনের মাধ্যমে ফেরেশতাদের দম্ভ চূর্ণ করে মানবের সম্মান সুরক্ষা করা হয়েছে; যার প্রভাবকরূপে আবির্ভূত হয়েছে ইসমে আজম আত্মস্থকারিণী ‘যাহরা’ নাম্নী নারী, যিনি আজও ‘জুহরা সেতারা’ নামে পরিচিত। যাঁর বিবরণ পাওয়া যায় কোরআন মজিদের সুরা বাকারায়, ১০২ নম্বর আয়াতে। (তাফসিরে আজিজি)।
পৃথিবীর সেরা রমণীদের ইতিহাসে আরও যাঁরা যুক্ত হয়েছেন, তাঁরা হলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাতা আমেনা ও দুধমাতা হালিমা সাদিয়া; চাচি ফাতেমা, মোমিন মাতা খাদিজা (রা.), হাফসা (রা.), আয়িশা (রা.), মারিয়াসহ (রা.) নবী–পত্নীগণ; নবী–নন্দিনী রুকাইয়া, জয়নব, কুলসুম ও ফাতিমা (রা.)। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.)-কন্যা আসমা, ইসলামের প্রথম শহীদ ‘শাহীদা সুমাইয়া’; নবীজির দুধ বোন সায়েমা; তাঁরা প্রত্যেকেই ইতিহাসে তাঁদের অবদান রেখে গেছেন।