ইসলামের প্রথম বাক্য হলো কালিমা তইয়্যেবা। কালিমা অর্থ শব্দ, বাণী বা বাক্য; তইয়্যেবা অর্থ পাক–পবিত্র। কালিমা তইয়্যেবা অর্থ পবিত্র বাণী, পাক কালাম বা পরিশুদ্ধ ঘোষণা। ইসলামের মূল বাণী পবিত্র কালিমায় এই ঘোষণাই দেওয়া হয়েছে: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’, অর্থাৎ ‘এক আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো প্রভু নেই, হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসুল।’ এই ঘোষণার পর মানুষ মানব-দানব সব সৃষ্টির গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং আদর্শ হিসেবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে গ্রহণ করে। এই কালিমা দ্বারা মানুষ মানব-দানব সব সৃষ্টির পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত স্বাধীনতা লাভ করে।
স্বাধীনতা আল্লাহর নিয়ামত। স্বাধীনতা যেমন মানুষের মৌলিক অধিকার, তেমনি ইসলামের মূল শিক্ষা। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.)
শুধু দাস মুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি; তিনি দাসকে সন্তান বানিয়েছেন, তিনি ক্রীতদাসকে ভাইয়ের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন, তিনি গোলামকে সেনা অধিনায়ক বানিয়েছেন। বংশানুক্রমিক দাসানুদাস হজরত বিলাল (রা.)-কে মসজিদে নববির প্রধান মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।
শুধু দাস মুক্ত করেই ক্ষান্ত হননি; তিনি দাসকে সন্তান বানিয়েছেন, তিনি ক্রীতদাসকে ভাইয়ের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন, তিনি গোলামকে সেনা অধিনায়ক বানিয়েছেন। বংশানুক্রমিক দাসানুদাস হজরত বিলাল (রা.)-কে মসজিদে নববির প্রধান মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।
ব্যক্তিস্বাধীনতা বনাম পরিবার ও সমাজ
ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে অনেকে পরিবারে ও সমাজে এমন কাজ করে, যা অন্যদের অনেকের অস্বস্তি ও বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিগত বিষয় ততক্ষণ ব্যক্তিগত থাকে, যতক্ষণ এর সঙ্গে কারও পছন্দ-অপছন্দ যোগ না হয়। অর্থাৎ যতক্ষণ এর প্রভাব ও ফলাফল শুধু ব্যক্তির নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। যখনই তা পরিবারের কোনো সদস্যকে উদ্দীপ্ত করবে, তখন তা হয়ে যাবে পারিবারিক; যখন তা সমাজের কোনো সভ্যকে প্রভাবিত করবে, তখন তা হয়ে যাবে সামাজিক; যখন তা রাষ্ট্রের কোনো নাগরিককে উদ্বুদ্ধ করবে, তখন তা হয়ে যাবে জাতীয়। মানুষ সামাজিক জীব হওয়ার কারণে তার জীবনের ব্যক্তিগত পরিসর খুবই সীমিত।
স্বাধীন নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ
আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। স্বাধীনতা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বাড়িয়ে দেয়। কোরআনুল করিমে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সহিত পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে বেশি মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩, পারা: ২৬)।
স্বাধীনতা ও সাম্য
জগতের সব মানুষ একই পিতা-মাতার সন্তান। সবারই পিতা বাবা আদম (আ.), সবারই মাতা মা হাওয়া (আ.)। তাই সব মানুষ ভাই ভাই, তাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। সাদা, কালো, লম্বা, খাটো—সবই আল্লাহর সৃষ্টি। বর্ণবৈষম্য, ভাষাবৈষম্য এবং ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য মানুষে মানুষে কোনো প্রভেদ তৈরি করে না। বিদায় হজের ভাষণে নবী করিম (সা.) বলেছেন: ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (বুখারি শরিফ)। অর্থাৎ কেউ কারও ওপর প্রভুত্ব কায়েম করতে পারবে না। সবার একমাত্র প্রভু মহান আল্লাহ।
ধর্মীয় স্বাধীনতা
ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা ও ন্যায়-অন্যায় বোঝার জন্য আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান দিয়েছেন। চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা দিয়েছেন এবং কর্ম অনুযায়ী পরকালে বিচার হবে। কর্মফল অনুসারে জান্নাত বা জাহান্নামের অধিকারী হবে। তাই আল্লাহ এই জগতে মানুষকে কোনো কাজে বাধ্য করেন না। এমনকি ধর্ম-কর্ম বিষয়েও জোর করা হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘ইসলামে জবরদস্তি নেই, সত্যাসত্য সুস্পষ্ট পার্থক্য হয়ে গেছে। যারা অশুভ অসুর শক্তিকে অস্বীকার করে মহান আল্লাহর প্রতি ইমান আনল; তারা মজবুত হাতল দৃঢ়ভাবে ধারণ করল, যা কখনো ভাঙবার নয়; আল্লাহ সর্বশ্রোতা মহাজ্ঞানী।’ (সুরা-২ [৮৭] বাকারা, রুকু: ৩৪, আয়াত: ২৫৬, পারা: ৩)।
স্বাধীনতা বনাম সর্বজনের অধিকার সুরক্ষা
একজন স্বাধীন মানুষ নিজের অধিকার রক্ষার পাশাপাশি অন্যের অধিকার সুরক্ষায় নিবেদিত হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘আমি কি তাকে তার জন্য দুটি চক্ষু সৃষ্টি করিনি? আর জিহ্বা ও ওষ্ঠ? সে তো বন্ধুর গিরিপথে প্রবেশ করেনি! তুমি কি জানো বন্ধুর গিরিপথ কী? এ হচ্ছে দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে আহার্য দান; এতিম আত্মীয়কে অথবা নিঃস্বকে। অতঃপর সে বিশ্বাসী মোমিনদের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং (তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়) যারা পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্যধারণের ও দয়া-দাক্ষিণ্যের। এরাই সৌভাগ্যশালী। আর যারা আমার নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছে, তারাই হতভাগ্য। তারা পরিবেষ্টিত হবে অবরুদ্ধ অগ্নিতে।’ (সুরা-৯০ [৩৫] বালাদ, রুকু: ১, আয়াত: ৮-২০, পারা: ৩০)।
স্বাধীনতা ও মূল্যবোধ
স্বাধীনতা উত্তম মূল্যবোধ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। স্বাধীন মানুষ সুন্দর মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়। পবিত্র কোরআনের বর্ণনায়, ‘তাকে পরীক্ষা করার জন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। আমি তাকে পথনির্দেশ দিয়েছি, হয়তো সে কৃতজ্ঞ হবে, নয়তো সে অকৃতজ্ঞ হবে।’ (সুরা-৭৬ [৯৮] দাহার, রুকু: ১, আয়াত: ২-৩, পারা: ২৯)।
স্বাধীনতা ও কৃতজ্ঞতা
স্বাধীনতার সুফল ভোগ করেও যারা অকৃতজ্ঞ হয়, তারা তার ফল ভোগ করবে। আল্লাহ তাআলার ঘোষণা: ‘কিতাবধারীদের মধ্যে যারা কুফরি করে এবং মুশরিকরা জাহান্নামের অগ্নিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে; তারাই সৃষ্টির অধম। নিশ্চয় যারা ইমান আনবে ও সৎকর্ম করবে, তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। তাদের প্রতিপালকের কাছে তাদের জন্য পুরস্কার হিসেবে রয়েছে স্থায়ী জান্নাত; যার নিম্নদেশ দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়, সেথায় তারা চিরস্থায়ী হবে। আল্লাহ তাদের প্রতি প্রসন্ন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। এটি তার জন্য যে তার প্রতিপালককে সমীহ করে।’ (সুরা-৯৮ [১০০] বায়্যিনাহ, রুকু: ১, আয়াত: ৬-৮, পারা: ৩০)।
চিন্তার স্বাধীনতা
মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন। স্বাধীনতা মানুষের মজ্জাগত, এটি মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি। মানুষ মনোজগতে সব সময় স্বাধীন; তাই সে বস্তুজগতেও স্বাধীন থাকা পছন্দ করে। মানুষ আল্লাহ ছাড়া কারও গোলামি করবে না, করবে না কারও দাসত্ব; এক আল্লাহর প্রভুত্ব ছাড়া কারও প্রভুত্ব স্বীকার করবে না।
মনস্তাত্ত্বিক স্বাধীনতা
স্বাধীনতা মানে সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা, সত্য গ্রহণের স্বাধীনতা, সত্য প্রচারের স্বাধীনতা, সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে চলার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা হলো সুন্দর, সুশীল, সুকুমারবৃত্তির চর্চার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে অসুন্দরকে বর্জন করার স্বাধীনতা, অসত্যকে অগ্রাহ্য করার স্বাধীনতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা মানে নীতি-নৈতিকতা, স্বাধীনতা মানে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, স্বাধীনতা মানে ন্যায়বোধ ও ন্যায়পরায়ণতা; স্বাধীনতা মানে অন্যায়ের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়া।