আপেল রাজ্যে একদিন
গ্রিক, রোমান, নর্স পৌরাণিক ও লোক কাহিনিতে আপেলের নাম পাওয়া যায় অমরত্বের ফল হিসাবে। বলা হয় দেবদেবীদের ফল। আবার নিষিদ্ধ ফল হিসেবেও আপেলের নাম শোনা যায়। আদি মানব আদম শয়তানের প্ররোচনায় যে নিষিদ্ধ ফল ‘গন্ধম’ খেয়েছিলেন, বলা হয়ে থাকে সেটিও আপেল।প্রচলিত কাহিনি হচ্ছে, বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন আপেল গাছের নিচে বসে চিন্তাভাবনা করতে করতে বিজ্ঞানের অমর একটি আবিষ্কার করে ফেলেন।
নিউটন সাহেব সেদিন আপেল গাছের নিচে বসেছিলেন বলেই নাকি আবিষ্কার হয়েছিল ‘মধ্যাকর্ষণ শক্তি’।
তবে বিজ্ঞানের নতুন কোন আবিষ্কারের আশায় নয়, কেবল গাছ থেকে নিজ হাতে আপেল ছিঁড়ে খাওয়ার আনন্দ পেতেই আমাদের যাত্রা ফিশকিল ফার্মের উদ্দেশ্যে।
যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে আপেল পিকিং বা আপেল তোলার মৌসুম শুরু হয় অগাস্টের শেষ দিক থেকে। তবে জোরেসোরে শুরু হয় সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। চলে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত।
এই সময়টায় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ফার্মে রীতিমতো উৎসব চলে। দর্শনার্থীরা বিভিন্ন ফার্মের আপেল বাগানে গিয়ে, নিজ হাতে আপেল সংগ্রহ করার এই উৎসবে যোগ দেন। কেবল গাছ থেকে আপেল ছিঁড়ে খাওয়া নয়, ইচ্ছামতো ব্যাগে ভরে নিয়ে যাওয়া যায় বাড়িতে।
গাছ থেকে পেড়ে খেতে টাকা দিতে হয় না। তবে বাড়ি নিয়ে যেতে, ওজন করে গুনতে হবে গাটের ডলার।
আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে ফিশকিল ফার্মের দিকে। গাড়ি চালাচ্ছেন সাংবাদিক মঞ্জু ভাই। সঙ্গী সাথিদের মধ্যে রয়েছে আমার সাংবাদিক স্বামী শামীম আল আমিন, কন্যা অপর্ণা আর টিবিএন টোয়েন্টিফোর টেলিভিশনের সিনিয়র ক্যামেরাপার্সন রফিক ভাই। গাড়ির মধ্যেই তখন হইহুল্লোড় আর আড্ডা জমে উঠলো।
নিউ ইয়র্কের আপস্টেটে মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা ফার্মটির ছবি দেখেছি ইন্টারনেটের সুবাদে। তথ্য ঘেটে জানলাম নিউ ইয়র্ক থেকে ৭১ মাইল দূরের এই ফার্মটি যুক্তরাষ্ট্রের সেরা দশটি ফার্মের একটি।
ফলে বাড়তি রোমাঞ্চ বোধ করছি। শহর ছেড়ে আমাদের গাড়ি তখন বহুদূর। পাহাড়ি পথে উঠে গেছে।
মসৃণ রাস্তায় এমনভাবে গাড়ি চলছে, যেন উড়ছে। আঁকাবাকা পথ কখনো উঠে যাচ্ছে উপরে, কখনো নেমে যাচ্ছে নিচে। কখনো মনে হচ্ছে, এই বুঝি আকাশের বুক চিরে ঢুকে যাবে ভেতরে।
রাস্তার দু’পাশে কখনো মানুষের বাড়িঘর, কিছু কিছু খাবারের দোকান। তবে বেশিরভাগ চোখে পড়লো দিগন্তবিস্তৃত ফসলি মাঠ। কোথাও উপত্যকা মিশেছে লম্বা একটি লেকে। ঝকঝকে আকাশ, তাই মেঘেদের খেলা নেই। সবুজের সমারোহে আমি যেন এক আগন্তুক!
একসময় আমাদের গাড়ি এসে থামলো ফিশকিল ফার্মের প্রধান ফটকে। ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে নিরাপদ জায়গাতে পার্ক করলেন মঞ্জু ভাই।
গাড়ি থেকে নেমে চোখ দুটো জুড়িয়ে গেল। থরে থরে সৌন্দর্যের পসরা। একপাশে কাঠ দিয়ে বানানো অভ্যর্থনা রুম। তার পাশে কাঠের বেঞ্চি আর টেবিলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বসার জায়গা। ছোট্ট সুন্দর একটি খাবারের দোকান চোখে পড়লো। কাঠ দিয়ে বানানো। পাশে বড় একটি গুদামের মতো জায়গা।
আধুনিক কৃষকদের ব্যস্ততা চোখে পড়লো। নারী-পুরুষ সমানভাবে কাজ করছেন। পোশাকে আশাকে ইংরেজি কোন চলচ্চিত্রের দৃশ্য যেন। ট্রাকটরের মতো গাড়ির ছোটাছুটি। যত দূর চোখ যায়, কেবল বাগান আর সবজি উদ্যান। একরের পর একর। কোথাও সমতল, কোথাও পাহাড়ি-উঁচুনিচু।
আমরা সবাই মিলে ঢুকে পড়লাম অভ্যর্থনা কক্ষে। সেখানে সহাস্যে একজন বয়স্ক নারী আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আপেল পিকিংয়ে এসেছি শুনে আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন কয়েকটি পলিথিনের লম্বা ব্যাগ। ফার্মে ঢোকার জন্যে ফিস দিতে হয় জনপ্রতি ৫ ডলার করে।
অজ্ঞাত কোন কারণে আমাদের কাছ থেকে সেই অর্থ নেয়া হলো না। তিনি আমাদের জানালেন, আপেল ছাড়াও আমরা তরমুজ, স্ট্রবেরি তুলতে পারি। আছে হরেক রকম সবজি। ক্ষেত থেকে তুলতে পারি সেগুলোও।
মাথার উপর গনগনে সূর্য। প্রচণ্ড খরতাপে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এখানে গরমটা একটু বেশিই লাগছে। আমরা পায়ে হেঁটে রওয়ানা হলাম আপেল বাগানের দিকে।
বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই, যেখানে আপেল পাওয়া যায় না। সব ফলের মধ্যে আপেলই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফল। কেবল আপেলকে কেন্দ্র করে সারা বিশ্বে বছরে কয়েক হাজার কোটি ডলার বাণিজ্য হয়।
ইউরোপ আমেরিকা আপেলের দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও জানিয়ে রাখি এই ফলটির আদি নিবাস হচ্ছে এশিয়া।
কিরগিজস্তান, তাজাকিস্তান ও কাজাকিস্তানে আপেলকে ‘আলমা’ নামে ডাকা হয়। ধারণা করা হয়, এই আলমা থেকেই এসেছে আপেল। ইউরোপে আপেল ছড়িয়েছে মহাবীর আলেকজান্ডারের মাধ্যমে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সালে তিনি মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশ জয় করে ফেরার সময় বেশ কিছু আপেল গাছ সঙ্গে করে নিয়ে যান। সেগুলো রোপণ করেন গ্রিসে। আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় সেখানে দ্রুত গাছটির বিস্তার ঘটে। সেখান থেকেই ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে সুস্বাদু ফলটি।
তবে উত্তর আমেরিকায় আপেল ঢোকে ১৬০০ সালের দিকে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৬২৯ সালের দিকে। বোস্টনে এই ফলের বীজ প্রথম রোপণ করার ১০ বছর পর ফল আসে। আমেরিকার ওয়াশিংটনে ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে বাণিজ্যিকভাবে এই ফলের চাষাবাদ শুরু হয়। এরপর গোটা আমেরিকা জুড়ে আপেলের প্রচুর চাষাবাদ হয়।
কিন্তু এরপরও এই দেশটি কিন্তু আপেল উৎপাদনে সারাবিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে। প্রথম স্থানে আছে চীন। বিশ্ব উৎপাদনের ৩৫ শতাংশই আসে চীন থেকে।
সাড়ে সাত শতাংশ আপেল জন্মে যুক্তরাষ্ট্রে। এছাড়া তুরস্ক, ইতালি, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, রাশিয়া, জার্মানি, ইরান ও ভারতে আপেলের প্রচুর চাষাবাদ হয়।
চোখের সামনে সারি সারি আপেল গাছ। আর তাতে থোকায় থোকায় আপেল ধরে আছে। একপাশে সবুজ আপেল অন্যপাশে, লাল। অপর্ণা খুশিতে হাতে তালি দিয়ে উঠলো। শুরু হলো তার ছোটাছুটি। আমি একটা আপেলের গায়ে হাত রাখলাম। এই প্রথম গাছ থেকে আপেল ছিঁড়ে খাওয়ার অনুভূতি পেতে যাচ্ছি। শিহরিত হয়ে উঠলাম। ছেঁড়া হলো। আহা কি রসালো আপেল। কি-না তার স্বাদ। চোখ দুটো বুজে এলো।
বলা হয়ে থাকে ‘অ্যান অ্যাপেল এ ডে, কিপস দ্য ডক্তর অ্যাওয়ে’। অর্থাৎ প্রতিদিন একটি আপেল খেলে রোগব্যাধি এত দূরে থাকে যে ডাক্তারের প্রয়োজন হয় না। কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। সবাই মিলে আপেলের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।
খুব পরিকল্পনা করে আপেল গাছগুলো লাগানো হয়েছে। আকারে মাঝারি এবং উপরের দিক ছাতার মতো ছড়ানো। উচ্চতায় ৬-১৫ ফিটের মতো হবে। তবে শুনেছি, বন্য আপেল গাছ উচ্চতায় ৩০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। আপেল গাছের পাতা উপবৃত্তাকার ও সবুজ।
ইন্টারনেট ঘেটে জেনেছি, একটি পুষ্পদণ্ডে আপেলের মোট পাঁচটি ফুল জন্মে। ফুলের রঙ গোলাপী। আর ফুলের পরাগায়ণ ঘটে থাকে মৌমাছির মাধ্যমে। তবে উন্নত দেশে নিশ্চয়ই এর বাইরে নানা প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়।
ইচ্ছামতো ছবি তোলা হলো। সেই সঙ্গে আপেল তোলা ও খাওয়া। আমাদেরকে দেয়া ব্যাগগুলো ভরে উঠলো।
আপেল বাগান থেকে আমরা গেলাম পাশের তরমুজ ক্ষেতে। সেখানে তরমুজ পেকে ফেটে ফেটে আছে। গাছ থেকে ছিঁড়ে এবার চললো তরমুজ খাওয়া। হাতে গায়ে লেগে গড়িয়ে পড়ছে তরমুজের রস। তবে এই স্বাদের কোন তুলনা হয় না। সবজি বাগানে কাটলো আমাদের অনেকটা সময়। এরপর যা কিছু তোলা হয়েছে, মিটিয়ে দেয়া হলো দাম।
সময় গড়ায় তার নিজস্ব নিয়মে। সময় হয়ে আসে বাড়ি ফেরার। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের এই লীলাভূমি ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করে না।
আমার ছোট্ট মেয়েটা যেভাবে প্রজাপতির মতো পাখনা মেলে ছোটাছুটি করছে, তাতে তাকে কীভাবে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো, সে এক ভাবনা। তবুও যেতে হয়। অনিচ্ছার পর, সকলে উঠে বসলাম গাড়িতে।
পেছনে ফিরে দেখলাম ফিশকিল ফার্মটাকে। আহা কি সুন্দর। আবারও আসবো।