মেঘ–পাহাড়ের সাজেক ভ্যালি

মেঘ–পাহাড়ের সাজেক ভ্যালি

sajek-valleyচাঁদের গাড়ির ছাদের সামনের জায়গাটা দখলে ছয় বছরের শিশু রবিউলের। তার পাশে বসা ইশতিয়াক। আমার জন্যও কিছুটা জায়গা বরাদ্দ আছে সেখানে। ফটোগ্রাফার ওমর ভাই ছাদের পেছনে বসে খোশগল্প জমিয়ে তুলেছেন ব্যাংকার শান্তনু দেবনাথের সঙ্গে। তাঁদের স্ত্রীরাও আছেন সে আড্ডায়। সিস্টেম রেস্টুরেন্টের তরুণ বাবুর্চি হাচিং মারমা দারুণ উচ্ছ্বসিত সাজেকের পথে যাত্রা করতে পেরে। খাগড়াছড়ির ছেলে হলেও কখনো সাজেক যাওয়া হয়নি তাঁর।
সাজেক নিয়ে আমার মধ্যে একদিকে যেমন দারুণ কৌতূহল, অন্যদিকে শিশু রবিউলকে নিয়ে চরম বিস্ময়! পাহাড়ি পথে ভ্রমণ করতেই ভয় পান অনেকে। অথচ এই পুঁচকে শিশু কিনা পুরো তিন ঘণ্টার পাহাড়ি পথে চাঁদের গাড়ির ছাদে!
sajek-valley3
খাগড়াছড়ি শহর ছাড়তেই সকাল ১০টা বেজে গেল। সিস্টেম রেস্টুরেন্ট থেকে রান্নার উপকরণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম থিউনচি মারমার চাঁদের গাড়িতে চেপে। ডিসেম্বরের শেষে কুয়াশার দাপট ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্রমেই শীতের কুয়াশা কেটে বেরিয়ে এল সূর্য। ঝলমলে রোদেলা আবহাওয়ায় কখন জানি দীঘিনালা, বাঘাইহাট, মাসালাং বাজার, কাসালাং নদীকে পেছনে ফেলে পৌঁছে গেলাম সাজেকের রুই রুই পাড়ায়।
এখানে এসে বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে গেল আরও। প্রায় দুই হাজার ফুট পাহাড়ের ওপর ঝকমকে প্রশস্ত পথ। শহরের আদলে তৈরি ফুটপাত একেবারে পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি। পথের পাশে পাহাড়িদের বাড়িঘর নান্দনিকভাবে সাজানো। মনে হলো, বিদেশি কোনো উপত্যকায় পাহাড়ের বুকে সাজানো-গোছানো আদিবাসী-অধ্যুষিত ছোট্ট কোনো শহরে এসে উপস্থিত হলাম।
পর্যটন উন্নয়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে দুর্গম সাজেকের উঁচু পাহাড়ের বুক চিরে। সাজেকে গড়ে উঠেছে রুনময় ও সাজেক নামে দুটো আকর্ষণীয় রিসোর্ট। পাহাড়ের কোল-ঘেঁষে বেশ কিছু কটেজ প্রস্তুত যেখানে রাত যাপন করতে পারবেন অল্প খরচে।
থাকার ব্যবস্থা হলো আলো রিসোর্টে। ব্যবস্থাপক লিটন চাকমা সব ব্যবস্থা করলেন। কাঠের তৈরি ছোট অথচ পরিপাটি একটা রিসোর্ট। বাবুর্চিকে রান্নার দায়িত্ব দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা কংলাক পাড়ার উদ্দেশে। রুই রুই থেকে উত্তরে অন্য একটি উঁচু পাহাড়ের ওপর কংলাক পাড়ার অবস্থান। সেখানে গাড়ি ওঠার পথ নেই। তাই পাহাড় বেয়ে উঠতে হলো আমাদের। লুসাই আর টিপরাদের বসবাস এ পাড়ায়। পুই লুসাইয়ের বাড়িতে পাকা পেঁপে খাওয়ার পর পথের ক্লান্তি যেন নিমেষেই হারিয়ে গেল। অসাধারণ স্বাদ এখানকার পাকা পেঁপের। সুস্বাদু কলাও পাওয়া যায় এখানে।
রুই রুই পাড়ার শেষ প্রান্তে হেলিপ্যাড। তার পাশেই পাহাড়ের কোলজুড়ে নির্মাণ করা হচ্ছে অবকাশ কেন্দ্র। এখানে বসলে মিজোরামের পাহাড়গুলো চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে অন্যরকম এক রূপ নিয়ে। সাজেক পাহাড় আর ভারতের পাহাড়ের মাঝখানে বিশাল এক উপত্যকাঞ্চল। এটাকে মেঘপুরীর উপত্যকাও বলা যেতে পারে। বর্ষাকালে এখানে থাকে মেঘমালার অবাধ বিচরণ। পাহাড়ের প্রশস্ত বুক, আদিবাসীদের ঘর-বসতি ও নির্জন প্রকৃতির সঙ্গে দারুণ এক সখ্য আছে ভাসমান মেঘপুঞ্জের।
রাতে বারবিকিউ পার্টির আয়োজনটা জমে উঠল। রিসোর্টের কর্মচারীরাও আমাদের এই কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করলেন স্বেচ্ছায়। সব মিলিয়ে জমজমাট এক পিকনিক রাতের পরিধিকে ছোট করে দিল। খুব সকালে উঠে কংলাক পাড়ায় চলে গেলাম আবার। এখান থেকে উপত্যকা অঞ্চলে তুলার মতো ভাসমান মেঘ দেখার মজাই আলাদা। প্রথম আলো জবসের লিঙ্কন ও ব্র্যাক ব্যাংকে কর্মরত সোহেলের পাহাড়ি অঞ্চলে বেড়াতে আসা এই প্রথম। এ ছাড়া কাউসার ভাইও ঘোরাঘুরির জগতে নতুন। তবে তাঁর ছেলে তো আমাদের তাক লাগিয়ে দিল পাক্কা একজন পর্যটকের মতো আচরণ করে। যাই হোক, কয়েকজন টিপরা নারীকে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পানি নিয়ে আসতে দেখে আমাদেরও কৌতূহল জাগল ঝরনাটা দেখে আসার। শুষ্ক মৌসুমে অনেক কষ্ট করে এখানকার অধিবাসীদের পানি সংগ্রহ করতে হয়।
এদিকে ইফতেখার ভাই ও ইশতিয়াক দুজনে ঘুমিয়েই সকালটা পার করে দিলেন। পরে অবশ্য আফসোস না করে পারলেন না। রুই রুই পাড়ার পাদদেশে দারুণ এক সংযোজন অ্যাডভেঞ্চার ট্রেইল। দুপুরে ফেরার আগে ওমর ভাই আর আমি ঢুকে পড়লাম সে ট্রেইলে। ভিন্নধর্মী অনেক কিছু আছে সেখানে। সেদিনই সাজেকের অনেক পর্যটন স্পট উদ্বোধন করা হবে। চারদিকে সাজ সাজ রব। সেনাসদস্যরা ভীষণ ব্যস্ত।
অপেক্ষা করার মতো সময় অবশ্য আমাদের হাতে ছিল না। ফিরে আসতে হলো খাগড়াছড়ি তিন ঘণ্টার আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার কলাবাগান, ফকিরাপুল ও কমলাপুর থেকে খাগড়াছড়িগামী যেকোনো বাস ধরে নামতে হবে খাগড়াছড়ি শহরে। এরপর জিপ বা চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ করতে হবে। জিপ ভাড়া আট থেকে নয় হাজার টাকা। সাজেকে থাকার জন্য সেনাবাহিনী পরিচালিত বিভিন্ন রিসোর্ট আছে। যাওয়ার আগে যোগাযোগ করে যাওয়া ভালো। যেকোনো মৌসুমে সাজেক ভ্রমণ অনন্য। তবে বর্ষাকালে এর সৌন্দর্য অসাধারণ।
sajek-valley2
أحدث أقدم