‘গোপাল
ভাড়ের ডাক্তার হয়ে ওঠার গল্প’
কোন
এক অশান্তির দেশে ছিলো এক আযব রানী। এবার মহারাজ কৃষ্ণ চন্দ্রের কাছে আবেদন এলো
সেখান থেকে। “গোপাল ভাড়কে কিছু সময়ের জন্য চাই! রানীর চিকিৎসার ভার নিতে হবে তাকে”।
ঘটনা
হল,
এমনিতেই
অশান্ত দেশ, সাথে অশান্ত রাজ্য সভায় ‘প্রাণ’ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন রানী হাসতারি রায়। অগ্রহনযোগ্য শাসনের কারনে এমনিতেই খাদ্য
গ্রহণে প্রচন্ড বাছবিচার করতে হত তার। দাসীদের খাইয়ে
তারপর মুখে খাবার উঠত।
এসময়ই
তার ভাবনা, অসুখে পড়লে তার কী উপায় হবে?
অন্যান্য
সব গুণ তো আছেই! সাথে কৃষ্ণ চন্দ্রের চিকিৎসা করে দেশ বিদেশে বেশ ডাক হয়েছে
গোপালের। তাই এহেন সমস্যায় গোপাল ভাড়ই ভরসা!
পত্র
পড়ে কৃষ্ণ চন্দ্রের দুশ্চিন্তা হল! অশান্তির দেশ! তার ওপর রানীর কোন বিশ্বাস নেই! হঠাৎ ক্যু হলে সাথে গোপালকেও
না হারাতে হয়! অন্যদিকে মানসম্মানের ব্যাপার! রাজার এহেন দোটানা অবস্থা দেখে যথারীতি গোপাল তাকে অভয় দিল। দ্রুত ফিরে আসার কথা
বলে রাজার মান বাঁচাতে রওনা হয়ে পড়লেন হাসতারির রাজ্যে। শত দুঃচিন্তার পরও রাজা
কৃষ্ণ চন্দ্রের মুখে যেন কোন দাগ না পড়ে সেইদিকে তার নজর।
অনেক
দিন হয়ে গেল। রানীর অসুখ হয়না আবার আশংকাও একবিন্দু কমেনা। এদিকে হাসতারি রায়
গোপালের মত বিশ্বস্ত লোক পেয়ে তাকে আর না ছাড়ার ফন্দি আটল। অশান্ত রাজ্যের ভয়ঙ্কর
রানী বলে কথা! গোপাল কোন না কোন ভাবে নানা ফন্দিতে সেই রাজ্যে অনেকটাই বন্দির মত
হয়ে পড়ল। পাহারাদার নিযুক্ত হল গোপালের জন্য। ফলে পালানোর উপায় ছিলোনা। সাথে বহু
দেশ থেকে আনা গোয়েন্দারা নজর রাখত তার ওপর। ফলে উল্টো-পেছন কিছু করতে গোপালের মন
সায় দিলনা। শেষে না কৃষ্ণ চন্দ্রের বদনাম হয়ে যায়!
এদিকে
রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের কাছে মিথ্যে পত্র পাঠিয়ে ছলনার রানী জানালো, গোপালকে সে অধিক
সময়ের জন্য রেখে দিতে চায়। তার প্রচন্ড অসুখ। ফলে রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র যেন ‘না’ করে
না বসেন।
এদিকে
গোপালকে বন্দীর মত ধরে রেখে নির্লজ্জতা নিয়ে রানী একদিন বিশেষ ফন্দি নিয়ে প্রশ্ন
করল,
কিরে
গোপাল! তুমি তো শুধুই ভাঁড় হতে চলেছ হে!
-কী
যে বলেন না নেত্রী!
আর কী
বলব কও! আজ অবধি না হল আমার অসুখ, না হল তোমার বিদ্যা জাহির! মাস শেষে বেতন গুনে
নিচ্ছ!
এমন
অসভ্য বাক্য প্রয়োগে গোপাল সত্যিই অস্বস্তিতে পড়ে গেল! ঘুম ছাড়া মানুষের অসুখ
হয়না, এমন কথা তার জানা ছিলোনা যে! সত্যিই আযব দেশ!
গোপাল
লজ্জা ঢাকতে মান বাঁচাতেই বলে বসল,
-নেত্রী যদি অভয় দিতেন তাহলে একটা আর্জি জানাতাম।
-নেত্রী যদি অভয় দিতেন তাহলে একটা আর্জি জানাতাম।
বলে
ফেল গোপাল।
-এত
দিন হয়ে গেল, সত্যিই আপনার কোন উপকারে লাগতে পারিনি। এটা মনে হলে আমিই যারপর নাই লজ্জিত
হয়ে পড়ি। আপনি যদি একটা সুযোগ দিতেন তাহলে আপনার দান করা অন্নের কিঞ্চিত গুণ
স্বীকার করতুম।
তা কী
ভাবে সেটা করবে শুনি! বল তো আগে!!
-আপনার
দেহে আর অসুখ হবেনা নেত্রী। এদিক থেকে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। তবে আপনার রাজ্যে যে
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আছে তার গায়ে ঢের অসুখ রয়েছে। কৃষ্ণ চন্দ্রের রাজ্যে আমি তো
সব কাজেই সাহায্য করতাম। কিন্তু আপনার রাজ্যের কুট কৌশল আমার জানা ছিলোনা। এখন যদি
নতুন অর্জিত জ্ঞাণের সফল প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে আমার গুণের পাখায় নতুন পালক যুক্ত হয়!
গোপালের
কথায় যার পর নাই অবাক রানী। বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন, গোপাল তুমি রাজনীতির রোগ
সারাবে কী করে? এ রাজ্যের রাজনীতির রোগ তুমি ধরতে পারবে?
-নেত্রী!
আপনার মত শিক্ষক থাকলে গোপালের কী সময় লাগে বলুন! আমি আপনাকে যত সময় সামনে দেখি, এ
রাজ্যের অন্য কেউ তো তত সময় আপনাকে সামনে পায় না। আমি ঢের সামলে নিতে পারব। আপনি
শুধু গোপালকে আশীর্বাদ করুন!
রানী
অবাক হয়ে ভাবলেন, গোপাল সত্যি বলেছে। গোপালের মাঝে চামচামির স্বভাব দেখে তার মনে
হল গোপাল এখন তার রাজ্যের গোপালে পরিনত হয়েছে। তার আশীর্বাদ চাওয়ার ব্যাপারটি কোন
স্বাভাবিক কর্ম নয়। গোপাল ধীরে ধীরে তার অর্চনা করতে শিখে নিয়েছে। ফলে, যেকোন কাজেই
গোপালের মত লোককে নিযুক্ত করার চেয়ে আর বড় কোন ভরসার কাজ তার সামনে নেই।
আর
ভাবনা নয়। রানীর প্রধান চিকিৎসক হিসেবে নতুন রাজ্যে বিশেষ পরিচিতির পর অশান্ত
রাজ্যের মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভিসি’ হিসেবেও গোপালের পরিচিতি ঘটল।
বিরোধী
পক্ষের মতধারী চিকিৎসক নাম দিয়ে রানীর অত্যাচার বিরোধী প্রধান প্রধান হেকিমদের
বিদায় করতে শুরু করল গোপাল। তার জহুরী চোখ এবার নতুন রাজ্যে নতুন আদর্শে কাজ করতে দারুন
পারদর্শিতা দেখালো। যদিও এ বন্দি জীবনে অশান্ত পরিবেশেও
গোপালের পুরনো বিবেক পুরোপুরি মরল না। তাই মাঝে মাঝে দরিদ্র ও অসহায় রোগীকে বিনা
মূল্যে চিকিৎসা দিয়ে বন্দি জীবনে কিছুটা সুখ নিতে ভুলত না সে।
মোশাহেবী
দেখানো এবং চামচামিতেও দারুন পারদর্শী হয়ে উঠল সময়ের ব্যাবধানে। অনিয়ন্ত্রিত
রাজ্যে কর্মক্ষেত্রে রাজার ছড়াছড়ি। রাজাদের রাজ্যে অন্যদের সাথে গোপালও একটা রাজা
হতে পেরে এখানেই থেকে যাবার মনস্থির করে নিল। ফলে, এবার লজ্জা নিবারনের কৌশলেই নাম বদল। নতুন রাজ্যে,
নতুন পরিবেশে এসে ঐতিহাসিক চরিত্র গোপাল ভাড় রানীর ‘প্রাণ’ রক্ষার দ্বায়িত্ব নিয়ে ‘গোপাল
দত্ত’ নামে পরিচিত হয়ে উঠল।
এভাবেই এ যুগের গোপাল ভাড় নির্ঘুম ও রোগহীন এক অত্যাচারীর কাছে বিশেষ চিকিৎসাবিদ্যা হাসিল করে প্রভাবশালী ডাক্তার হয়ে উঠল।