গন্তব্য জয়পুর
আমি বরাবরই ইংরেজি ক্লাসে কানমলা খেয়ে বেরিয়ে আসা ছাত্র, তার ওপর কলকাতার খাঁটি বাংলা বলতে কোনো দিনই অভ্যস্ত নই, আর হিন্দি-একটি, দুটি শব্দ মাত্র বলতে শেখা সাকুল্যে ভাষা বাবদে এই আমার জ্ঞান। আর এই জ্ঞানের বিষয়টা টের পেলাম রাজধানী এক্সপ্রেসে কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে। টিকিট কিনেছি আত্মীয় মারফত, ভারতীয় হিসেবে একটু সস্তায়। ট্রেনে আমার সহযাত্রী একজন সস্ত্রীক কলকাতার বাঙালি। আর অন্যজন পাতলা, চিকন শিখ। সুতরাং এই হিন্দিভাষী শিখ আর কলকাতার বাঙালির মাঝে চুপ থাকাই ভালো। তবে বাচাল বলে বেশিক্ষণ চুপ থাকাও গেল না। মুহূর্তেই আমার বাংলা-হিন্দির দু-এক লাইনের বহর শুনে বাঙালিটি চোখ টিপে প্রশ্ন করলেন, ‘ঢাকা থেকে আসা হয়েছে বুঝি?’মুখে বললাম, ‘আলবত’। মনে মনে বললাম, ‘এই সেরেছে।’ তবে ততক্ষণে টিকিট চেকিং শেষ। আর আমাদের ট্রেনও ধূলি উড়িয়ে নিয়ে বর্ধমান হয়ে বহরমপুরের ভেতর দিয়ে উড়িষ্যার গোধূলিতে ছুটে চলে, বিহারের রাতের আঁধারে গলে গেল। গন্তব্য দিল্লি হয়ে জয়পুর-উপলক্ষ নিখিল ভারত চক্ষু চিকিৎসক সম্মেলনে যোগ দেওয়া আর উদ্দেশ্য ভ্রমণ। এই রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনে কলকাতা থেকে দিল্লি যাওয়ার লোভ অনেক দিনের। আমাদের বাংলাদেশি অপরাপর চক্ষু চিকিৎসকদের সঙ্গে সরাসরি উড়ালপথে ঢাকা-দিল্লি না করে তাই কলকাতা হয়ে রাজধানী এক্সপ্রেসে চেপে বসা। টিকিট কিনতে হয় প্রায় এক মাস আগে। অবশ্য বিদেশি কোটায় পাওয়া যায় সঙ্গে সঙ্গে, তবে টাকা খরচ হয় অনেক বেশি।
অনেক ট্রেনে টু-টায়ার, থ্রি-টায়ার ইত্যাদিভাবে শয়ন-আসন বিন্যস্ত। বসে, শুয়ে-ঘুমিয়ে দিব্যি দিল্লি চলে যাওয়া যায়। স্টুয়ার্ড এসে মাঝেমধ্যে চা, বিস্কুট, স্ম্যাকস, রাতের খাবার ইত্যাদি দিয়ে যায়। বেশ এ দেশে। একবেলা, একরাতের ভ্রমণে পাশের যাত্রীর সঙ্গে সখ্য গড়তে সময় লাগে না। যা হোক, বিহারের রাত উত্তর প্রদেশের মোগল সরাইয়ে জেগে উঠল। এরই মধ্যে বাংলার সবুজ, সজীব রূপ আস্তে আস্তে রুক্ষ বিবর্ণ হয়ে ধানক্ষেত কখন গমক্ষেতে হারিয়ে গেল। মাটির বিষ-কালচে রং আর নেই। রুক্ষ, সবই রুক্ষ, মধ্যবেলা নাগাদ দিল্লি পৌঁছাই। বাল্যবন্ধু চঞ্চলের সঙ্গে প্রায় দুই যুগ পর দেখা হওয়ার উত্তাল অনুভূতিতে কেটে গেল সময়। এরই মধ্যে আমার ঢাকার বন্ধুরাও দিল্লির মাটিতে নেমে পড়েছে। পরদিন ভোরে একটা ঢাউস বাসে ঠাসাঠাসি। আর দিল্লি থেকে ইন্ডিয়ান হাইওয়ে ধরে জয়পুরের দিকে ছুটে চলা। ভারতে শহর থেকে শহরময় ছুটে চলার ইন্ডিয়ান হাইওয়ে একটা দেখার মতো জিনিস। মসৃণ, বাঁকহীন আর দুই ওয়ের মাঝের চওড়া আইল্যান্ডে মানুষের হাতের ছোঁয়ায় সৃষ্ট একেকটা রক্তকরবী, বাগানবিলাস আর কল্কে ফুলের বনানী।
দিল্লি ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের হাইওয়ে ঢুকে পড়ল দিগন্তবিস্তৃত রাই সরিষার ক্ষেতের ভেতর। যত দূর চোখ যায় শুধু সরিষার ক্ষেত। যোজন-যোজন, মাইলের পর মাইল। এর মধ্যে ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে কিছু কাঁটা বাবলার গাছ। পরে জেনেছি রাজস্থানের মরু আবহাওয়ায় এত অল্প বৃষ্টিতে সরিষাই নাকি একমাত্র উত্তম ফসল। কিন্তু এত যে ওদের সরিষা, খাবার বেলায় তার ব্যবহার তেমন চোখে পড়ল না। সরষের ভর্তা, সরষের কাসুন্দি, সরষে পাতার জেলি!! আহ!! ওদের জায়গায় আমরা হলে সরষের পদ দিয়েই একসন্ধ্যার খাবারের টেবিল সাজিয়ে দিতে পারতাম। খাবার প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ভারতজুড়ে তাবৎ খাদ্যবস্তু মূলত দক্ষিণ আর উত্তরে বিভক্ত। এর মধ্যে আবার আমিষ আর নিরামিশ।তবে দক্ষিণের মেন্যুটাই বেশি চলে। অর্থাৎ ইডলি, রায়তা। উত্তর ভারতীয় খাবার বলতে যা বোঝায় তা হলো নানরুটি, কাবাব, পোলাও ইত্যাদি যত মোগলাইয়ের বিবর্তন। তবে বিশ্বাস করুন, আমাদের ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানি বা মোরগ পোলাওয়ের কাছে ওই সব মোগলাই নস্যি। পথিমধ্যে রেস্টুরেন্টে ডাল-ভাত খাওয়ার মওকা পেয়ে আহারান্তে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে চায়ের অর্ডারে যা এল তা চা নয় বরং তেজপাতা, গরম মসলা ইত্যাদির সঙ্গে দুধ মিশিয়ে রীতিমতো রান্না করা চা। পরে সম্মেলনস্থলেও একবার-দুবার ‘চা’ বিরতিতে সেই একই বস্তুর দর্শন পেয়েছিলাম। এরপর রাজস্থানে আর কোনো দিন চা খাইনি। চায়ে যদি চায়ের ফ্লেভার না-ই থাকে, তাহলে কি আর চা হলো। যাকগে সেসব কথা, বেলা দুইটা নাগাদ দুই পাহাড়ের ফাঁক গলিয়ে আমাদের বাস ঢুকে পড়ল জয়পুর সিটিতে- সোজা রাজবাড়ি, ওরা বলে সিটি প্যালেস। রাজা জয়সিংহ সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পাহাড়ি আস্তানা ছেড়ে উপত্যকার সমতলে এসে শহরের গোড়াপত্তন করেন-বড়ই পরিকল্পিত শহর। রাস্তাগুলো প্রশস্ত, লম্বালম্বি এবং একে অপরের সমান্তরাল; বাড়িগুলো একই মাত্রার, একই রঙের।
পিংক সিটি। চমৎকার। এরই প্রাণকেন্দ্র সিটি প্যালেস। দর্শনীর বিনিময়ে প্রাসাদ দর্শন, প্রস্তুত গাইডও মেলে বিভিন্ন ভাষার। নিজেদের উদ্যোগে ভাষা রপ্ত করে নিজেরাই কর্মসংস্থান করে নিয়েছে। পাতলামতো এক ছেলে দেখলাম কয়েকজন গৌরবর্ণ পর্যটক নিয়ে দিব্যি রুশ বলে বেড়াচ্ছে। আলাপে জানলাম, ক্নিনকালেও রুশ দেশে যায়নি। অথচ কি চোস্ত রুশ ভাষাটাই না বলছে ছেলেটা। সব প্রাসাদেরই দর্শনীয় বস্তুর ধরন এক-রাজার ব্যবহার্য জিনিসপত্র, বিভিন্ন কীর্তির নমুনা, বিভিন্ন সংগ্রহ ইত্যাদি। এই সুবর্ণখচিত, কারুকার্যখচিত প্রাসাদেও এর ব্যত্যয় নেই। তবে এ রাজবাড়ির আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য হলো, ‘যন্তর-মন্তর’। রাজা নিজে জ্যোতির্বিদ্যার পূজারি ছিলেন। তাই গড়ে তুলেছেন চমৎকার একটি মানমন্দির, যা নক্ষত্র নিরীক্ষণের-নিরূপণের বিভিন্ন নিখুঁত যন্ত্রপাতি আর সূক্ষ্ম গাণিতিক হিসাবের সমীকরণে সজ্জিত। কয়েকটি সূর্যঘড়ি দেখার মতো। এ রাজা ভারতজুড়ে নাকি আরও কয়েকটি মানমন্দির স্থাপন করেছিলেন। রাজা গুণী বটে! পরে সম্মেলন থেকে মাঝেমধ্যে পালিয়ে গিয়ে কিছু কিছু জায়গা দেখেছি। হাওয়া মহল, জলমহল ইত্যাদি। তবে এর মধ্যে পাহাড়ের গায়ে স্থাপিত ‘আম্বর প্যালেস’। আগে মূল রাজবাড়ি ছিল এখানেই-দুর্গবেষ্টিত রাজপ্রাসাদ। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। চীনের গ্রেটওয়ালের মিনি সংস্করণ। শৈলমূলে পৌঁছে হাতিতে চড়ে প্রাসাদে ওঠার ব্যবস্থা। হাতিগুলোও আবার রাজহস্তী আদলে সজ্জিত-কয়েক ঘণ্টার রাজা বনে দুধে ঘোলের সাধ মেটাতে পারেন। প্রাসাদে মোগলাই, দক্ষিণ আর উত্তর ভারতীয় স্থাপত্যরীতির এক অদ্ভুত মিশ্রণ চোখে পড়বে। দোতলায় একটি কক্ষে অনবরত সেতার, সারেঙ্গী-তবলার সংগত মাহফিলের ব্যবস্থা আছে। হাতি চড়ে রাজস্থানের পাহাড় দর্শন হলো বটে। উটের পিঠে চড়ে মরুভ্রমণ আর হলো না-আমি উটের পিঠে চড়ার কায়দাটা ফেলুদার কাছ থেকে শিখতে পারিনি কিনা। তা ছাড়া আমাদের হাতে সময়ও ছিল না। তার আগেই রাজস্থানকে গুডবাই জানিয়ে আগ্রার পথে পা বাড়ালাম। মাঝে শুধু একটি দিন ধার্য ছিল আজমির গিয়ে পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য। এবার আগ্রা, তাজমহল, মোগল সাম্রাজ্য-আকবরের দেশ, শাহজাহানের দেশ। পথে ফতেহপুর সিক্রি-সম্রাট আকবর তাঁর ধর্মগুরুর জন্য একজায়গায় একটি আস্তানা গড়ে দিয়েছিলেন। ক্রমে ভক্তসমাগমে আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে ফতেহপুর সিটি। এখন সেখানে আছে ধর্মগুরু সেলিম চিশতির সমাধি মাজার। একে ঘিরে বিশাল বিশাল তোরণ, মসজিদ, ভক্তদের বিশ্রাম, অজু করার স্থান ইত্যাদি। সব কিছুতেই উত্তর ভারতীয় মোগল স্থাপত্যরীতি অনুসৃত। সময়স্বল্পতার কারণে কোনো কিছুই ভালো করে দেখা হলো না। শুধুই ভেতরে ঢুকে ইতিউতি ক্যামেরার ক্লিক ফ্ল্যাশ। যেন এই কর্মটির জন্যই আসা। বেলা থাকতেই তাজমহলে ঢুকতে হবে। নইলে সব মাটি। তাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলা আগ্রার দিকে। আগ্রা পৌঁছা গেল। আমাদের অপেক্ষারও আর তর সইছিল না। তাজমহল আর চোখের সামনে ভাসে না। দূরে গম্বুজের মতো কিছু দেখলেই মনে হয় এসে গেছি। কিন্তু তাজমহল যে শহর থেকে দেখার কোনো সুযোগ নেই। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। অবশেষে বাস এসে একটা মোড়ে দাঁড়াল। এখান থেকে মাইলটাক যেতে হবে ধোঁয়াবিহীন ব্যাটারিচালিত গাড়িতে। নির্ঘাত ‘তাজ’-এর চারদিকের পরিবেশ রক্ষার কৌশল। এবার সার্কভুক্ত দেশের কোটায় টিকিট কিনে কয়েকটি নিরাপত্তাবেষ্টনী পেরিয়ে ঢুকে পড়া। মূল তাজমহলে যেতে দুটি সুউচ্চ তোরণ, বিশাল এলাকা ঘিরে প্রাচীর-সবকিছুই অপূর্ব কারুকার্যশোভিত। মূল তোরণের দিকে এগিয়ে যেতেই ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল তাজমহল। শ্বেতশুভ্র তাজমহল। তাজ মানে মুকুট আর মহল মানে প্রাসাদ-সব প্রাসাদের মুকুট। পারস্য বংশোদ্ভূত উচ্চ রাজকর্মচারীর কন্যা মমতাজ। রাজপরিবারের পাশেই জন্ম, বেড়ে ওঠা, ক্রমে সম্রাটপুত্র শাহজাহানের সঙ্গে পরিচয়, প্রণয় এবং সম্রাটপত্নী। কত দিনের ভালোবাসা, প্রেম-বিধি সইল না। প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু স্পর্শ করল রাজপ্রাসাদকেও-হারিয়ে গেলেন পরম মমতার মমতাজ। যাওয়ার আগে স্বামীর হাত দুটো ধরে বলে গেলেন, ‘কথা দাও, কথা দাও, তুমি আর কাউকে ভালোবাসবে না, বিয়ে করবে না। আর যদি পারো, আমার নামে একটি ্নৃতিস্তম্ভ করে আমাকে ্নরণ কোরো।’ সম্রাট শাহজাহান কথা দিয়েছিলেন। কথা রেখেওছিলেন। পারস্য দেশের স্থপতি এনে, পৃথিবীর তাবৎ দেশের বিভিন্ন উপাদান এনে, হাজার হাজার শ্রমিক খাটিয়ে কুড়িটি বছর ধরে রচনা করেছিলেন যমুনাপারের এই বিষাদময় মহাকাজ। তাজমহলের প্রতিটি মার্বেল পাথর, প্রতিটি টালি, প্রতিটি কারুকার্যনির্মিত পরম যত্নে, পরম মমতায়। এখানে স্থাপত্যকলা, গাণিতিক মাত্রা, শুদ্ধতা, রুচি, দ্বিমাত্রিক পরিমিত। সব এসে একত্র বন্ধনে তৈরি হয়েছে এই অপূর্ব শিল্প সৃষ্টি। আর একে বিষাদময় করে তুলেছে যমুনার এই বাঁকটি। এককালের ভরাগর্ভ যমুনা এখন শীর্ণকায় স্রোতরেখা। ক্রমে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা এল-একসময় যমুনার পশ্চিমে সূর্যকে বিদায় দিয়ে পুব আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। অস্তগামী সূর্যের সোনালি আভায় পুরো পরিবেশ ভারী হয়ে উঠল। মনটা কেমন হয়ে গেল। আমার পরিবারের হারিয়ে যাওয়া মুখগুলো মনে এল। সেই শৈশব থেকে এদের সঙ্গে আমার বন্ধন। কত মানুষ একে একে হারিয়ে গেল। বাল্যকালের স্কুলের কত বন্ধু, কত শিক্ষক, শিক্ষাজীবনের, কর্মজীবনের কত সহকর্মী হারিয়ে গেল কালের গর্ভে-তারা আর কখনো ফিরে আসবে না। সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধায় চোখে জল চলে এল। এই তাজমহল এমন জায়গায় এমনভাবে গড়া যে এখানে এলে মনটা ভারাক্রান্ত না হয়ে পারে না। এমন অনুভূতি হয় বলেই হয়তো এই তাজমহল আমাদের সংস্কৃতিচর্চার বিশাল অবলম্বন। পিন্টু ভট্টাচার্যের গাওয়া গানটি-‘এক তাজমহল গড়ো হৃদয়ে তোমার আমি হারিয়ে গেলে’-কী দরদ দিয়ে লেখা, কী অপূর্ব সুর, কী চমৎকার গায়কি!
হঠাৎ নিরাপত্তাকর্মীর ডাকে সংবিত ফিরে এল। দেখতে দেখতে কখন সময় গড়িয়ে গেল। এবার যেতে হবে। চাঁদের আলোয় আর তাজমহল দেখা হলো না। শুনেছি প্রতি পূর্ণিমার চার রাত তাজকে ঘিরে নাকি স্বর্গীয় আবহ নেমে আসে, কিন্তু তা দেখার সৌভাগ্য আর হলো না। তার জন্য অগ্রিম টিকিট অনেক আগে থেকেই করতে হয়। আপাতত পূর্ণিমার তাজ দর্শন অপূর্ণই থেকে গেল।