সাধনার জোরেই আজ চিত্রকূট মহাতীর্থ
ভারতের আদি পীঠস্থান চিত্রকূট উত্তরপ্রদেশের বান্দা জেলা আর মধ্যপ্রদেশের সাতনা জেলা জুড়ে বিছিয়ে রয়েছে। এ দেশে খুব কম এলাকাকেই এই ভাবে দুটি রাজ্য জুড়ে থাকতে দেখা যায়। ১৯৯৮ সালে উত্তরপ্রদেশের কার্বি আর মউ তহসিল মিলিয়ে এক জেলা সৃষ্টি হয়, তার নাম দেওয়া হয় চিত্রকূট। উত্তরপ্রদেশের অংশ হলেও মধ্যপ্রদেশের অধিকাংশ পীঠস্থানের মতো চিত্রকূটের পরিবেশ িস্নগ্ধ, শান্ত। প্রকৃতির উপিস্থতিতে চিত্রকূটের মাধূর্য সম্যকভাবে প্রকাশ পায়, উত্তরপ্রদেশের ঝঁাঝ এখনও এখানে পৌছতে পারেনি।চিত্রকূট যে কত পুরনো তার হিসেব করা মুসকিল। ইতিহাস ছাড়িয়ে মহাকাব্যের পাতায় চিত্রকূট জায়গা করে নিয়েছে। বাল্মিকির রামায়ণে প্রথম চিত্রকূটের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৪ বছর বনবাসের আদেশ পেয়ে লক্ষ্মণ আর সীতাকে নিয়ে রামচন্দ্র যাত্রা শুরু করলেন। তার আগে মুনি ঋষিদের আশীর্বাদ নিতে গেলে তারা পরামর্শ দেন, এই দীর্ঘ সময় কাটানোর আদর্শ জায়গা চিত্রকূট পাহাড়। জঙ্গলে ঘেরা এই পাহাড়ি অঞ্চলে মনে শান্তি ফিরবে, আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ প্রশস্ত হবে। সেই পরামর্শ শিরধার্য করে মন্দাকিনী আর পয়োস্বিনী নদীর ধারে চিত্রকূটকে বেছে নিলেন রামচন্দ্র।
রামায়ণের সঙ্গে সম্পর্ক এইখানেই শেষ নয়। ধীরে ধীরে বছর কাটতে থাকে। এ দিকে পুত্র শোকে দশরথ এক দিন প্রাণত্যাগ করলেন। রামচন্দ্র তখনও চিত্রকূটে। পিতার মৃত্যুসংবাদ নিয়ে অগ্রজের কাছে হাজির হলেন ভরত। সঙ্গে করে আনলেন দেশের বিভিন্ন নদীর জল। তৈরি হল ভরতকূপ, যা এখনও দেখা যায়। পিতার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে আমিন্ত্রত হলেন দেবদেবীরা। চিত্রকূট এসে তারা বিস্মিত। এমন দেশ তো স্বর্গেও নেই। এ জায়গা তারা ছেড়ে যেতে চাইলেন না। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের মন্ত্র পাঠ করছিলেন বশিষ্ঠমুনি। তিনি সব কথাই টের পেলেন। আশ্চর্যভাবে তিনি বিসর্জন মন্ত্র উচ্চারণ করতে ভুলে গেলেন। সেই থেকে সমস্ত দেবদেবী চিত্রকূটেই রয়ে গিয়েছেন।
এই ঘটনার পর থেকেই চিত্রকূট তীর্থস্থান হয়ে গেল এমন ভাবা হয়ত ঠিক নয়। রামায়ণে চিত্রকূটের বর্ণনার আগে থেকেই চিত্রকূট তীর্থস্থান হিসেবে প্রতিিষ্ঠত। বহু বহু যুগ ধরে এখানে সাধুসন্ত মুনি ঋষিদের সমাগম। এই প্রাচীনত্ব এমনই যে বাস্তব বা মহাকাব্যের গণ্ডী পেরিয়ে তা গল্প কাহিনীর রাজেত্ব পৌছেছে। সেই সব কাহিনীতে নদীরা মানুষী, তীর্থস্থানেরা মানুষ।
কাহিনী হল তীর্থের রাজা প্রয়াগরাজকে দর্শন করতে প্রত্যেক বছর বিভিন্ন তীর্থ তার কাছে আসেন। আজকালকার এলাহবাদকে সে সময় প্রয়াগরাজ বলা হত। প্রয়াগরাজ দেখেন সবাই আসে বটে, শুধু চিত্রকূটের দেখা নেই। তখন তিনি সন্ধান করে জানতে পারেন, তীর্থ হিসেবে চিত্রকূটের স্থান প্রয়াগের ওপরে। দর্শন দিতে নয়, তাকেই যেতে হবে চিত্রকূট দর্শন করতে। এ কথা শোনার পর প্রত্যেক বছর একবার করে চিত্রকূটে গিয়ে প্রয়াগরাজ মন্দাকিনীতে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
চিত্রকূটের আকর্ষণ রামায়ণে থেমে থাকেনি। মহাকবি কালিদাস চিত্রকূট সম্পর্কে অভিভূত হয়ে ছিলেন। মেঘদূত কাব্যে যক্ষকে তিনি রামগিরিতে নির্বাসন দেন। সেই রামগিরি আসলে চিত্রকূটই। কালিদাসের অপর কাব্য রঘুবংশেও চিত্রকূটকে পাওয়া যায়। তবে চিত্রকূটের জনিপ্রয়তা বাড়ে ষোলো শো শতাব্দীতে তুলসীদাসের রামচরিতমানস রচনার পর। এই রচনা ছাড়াও, কবিতাবলী, দোহাবলী আর বিনয় পত্রিকাতে চিত্রকূটের উেল্লখ রয়েছে। তুলসীদাসের সঙ্গে চিত্রকূটের যে নিবিড় যোগাযোগ তার প্রকাশ পাওয়া যায় বিনয় পত্রিকার ছত্রে ছত্রে। রামচন্দ্র ছিলেন তার ইষ্টদেবতা, তার সাধনায় তুলসীদাসের জীবন কাটে। চিত্রকূটে, মন্দাকিনীর ধারে রামঘাটের ওপরেই রয়েছে তুলসীদাসের মূর্তি, যে ঘাটে তার প্রাণের দেবতা নিত্য আসতেন বলে কবি কল্পনা করেছেন। সেইখানেই পরবর্তীকালে মানুষ তুলসীদাসের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছে।
তুলসীদাসের গ্রন্থ প্রকাশ পাওয়ার পর চিত্রকূটের সঙ্গে রামের যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করে সে জায়গার জনিপ্রয়তা বেড়েছে। চিত্রকূটকে রামের জায়গা বলেও চিিহ্নত করা হয়েছে। কিন্তু এ সবই ষষ্ঠদশ শতাব্দীর পর। এখানকার মিন্দরগুলো তৈরি হয় তারও পরে, অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে। অথচ ষষ্ঠদশ শতাব্দীর আগেও চিত্রকূট ছিল। কালিদাসের সময় বা তারও আগে থেকে চিত্রকূট প্রতিিষ্ঠত। ষষ্ঠদশ শতাব্দীর আগে চিত্রকূটে ছিল শিবের আধিপত্য। ভরতকূপের নামও আলাদা ছিল। ভরতকূপ আর গুপ্ত গোদাবরী ছিল শিবের স্থান। এমন কি, চিত্রকূটে আসা তীর্থযাত্রীরা যে মত্তগজেন্দ্রনাথের মিন্দরে পুজো দিয়ে যাত্রা শুরু করেন, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং মহাদেব। শুধু তাই নয়, সিদ্ধাশ্রম, কোটিতীর্থ ভরতকূপ বা গুপ্ত গোদাবরীর রক্ষক রাম নন, মহাদেব। সুতরাং, মহাদেবকে চিত্রকূটের আদি দেবতা বললে খুব কিছু ভুল বলা হবে না।
রাম বা মহাদেব ছাড়াও চিত্রকূটে আরও প্রাচীন এক দেবতার উেল্লখ পাওয়া যায়, যিনি শিবও নন, রামও নন, আবার কোনও দেবীও নন। এর নাম কামনাথ বা কামাদনাথ। চিত্রকূটে কামাদগিরি বলে এক পাহাড় আচে, সেখানে এর বাস। বর্তমানে এই কামাদগিরিতে রাম লক্ষ্মণের মূর্তি থাকলেও এই কামাদনাথ যে ঠিক কোন দেবতা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কোনও কোনও পণ্ডিতমহলের ধারণা, এমনও হতে পারে এই কামাদনাথ কোনও পুরনো সভ্যতা অর্থাৎ আদিবাসীদের দেবতা। সে সভ্যতায় পাহাড় গাছ প্রভৃতি প্রাকৃতিক জিনিসকে দেবতাজ্ঞান করা হয়।
শিব রাম বিষ্ণু এবং প্রাচীন দেবতা মিলে চিত্রকূট সত্যি সত্যি শ্রেষ্ঠ তীর্থের পদে অধিিষ্ঠত। বিশ্বাসে ভর করে লক্ষ লক্ষ মাানুষ আসে এখানে। রামনবমী জন্মাষ্টমী নবরাত্রির মেলায় আলো ঝলমল করে এই ছোট্ট নির্বিবাদী শহরে। দীন দরিেদ্রর বারানসী বলে পরিচিত এই চিত্রকূট হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাসের আধার হয়ে রয়েছে। অনেক চর্চা করেও প্রমাণ করা যাবে না রাম লক্ষ্মণ আর সীতা বলে তিনজন এখানে অতগুলো বছর কাটিয়ে ছিলেন। তবু বিশ্বাসের জোরে তারা এখানে প্রতিিষ্ঠত হয়ে গিয়েছেন। তাদের অনুসরণ করছি ভেবে দীর্ঘকাল ধরে মানুষ আত্মিক উন্নতির লক্ষে সাধনা করে চলেছে। তাদের সেই সাধনার জোরেই চিত্রকূট হয়ে উঠেছে মহাতীর্থ।