স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর আমার দেশ
নীলাচলবান্দরবানের পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা স্বাদ পেতে হলে নীলাচল যাওয়ার বিকল্প কোনো পথ নেই। এখান থেকে একনজরে পুরো বান্দরবান শহর দেখতে পারা যায়। আবছাভাবে নীলগিরিও চোখে পড়বে। এড়িয়ে যাবে না কেওক্রাডং যাওয়ার হাঁটাপথের রাস্তাটুকুও। ঠিক ভোরবেলা আর সন্ধ্যার পর এখানে মেঘের বাজার বসে। এখানে একটা কটেজও আছে, যেখানে আপনি দুই হাজার ৫০০ টাকার বিনিময়ে একটা শিরশিরে মেঘলা রাত কিনে নিতে পারবেন।
কীভাবে যাবেন
বান্দরবান শহর থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে নীলাচল যেতে পারেন। আসা-যাওয়া মিলিয়ে ভাড়া পড়বে ৮০০ টাকা। যাওয়ার পথে ওপরে ওঠার সময় আপনাকে অনেকবারই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হবে। ফেরার সময় ট্যাক্সিচালককে বলবেন স্টার্ট বন্ধ করে নামতে। জীবনে যে আনন্দের কতটা বাঁক থাকতে পারে, সেটা বুঝবেন সেদিন। ইঞ্জিনের সাহায্য ছাড়াই ১৫ কিলোমিটার দূরের বান্দরবান শহরে চলে আসবেন।
চিংড়ি ঝরনা
বগালেক থেকে ঘণ্টা দেড়েক কেওক্রাডংয়ের দিকে হাঁটতে থাকলে কানে আসবে পানি বয়ে যাওয়ার ঝিরঝিরে এক মিষ্টি শব্দ। এই শব্দের উৎসস্থল কিন্তু আরও অনেক ভেতরের দিকে। লাঠি ঠুকে ঠুকে পিচ্ছিল পাথরের গা বেয়ে ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে থাকলে হঠাৎ করেই নজরে পড়বে বিশাল বান্দরবানের আরও একটি লুকানো সৌন্দর্য। আধখানা চাঁদের আকৃতি নিয়ে রিমঝিম শব্দে সারাটা এলাকা মাতিয়ে রেখেছে যে ঝরনা, তার নাম চিংড়ি ঝরনা। একটু খুঁজলেই ঝরনার পানির বয়ে যাওয়া জমানো পানিতে দেখতে পাবেন চিংড়ি মাছের দৌড়াদৌড়ি।
কীভাবে যাবেন
বগালেক থেকে ঘণ্টা দেড়েক কেওক্রাডংয়ের দিকে হাঁটলেই পেয়ে যাবেন চিংড়ি ঝরনা। প্রথমে হাতের বাঁয়ে একটা ঝরনা পড়বে। সেটা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন। দ্বিতীয় ঝরনাই হলো চিংড়ি ঝরনা।
জাদিপাই ঝরনা
অরণ্যের আড়ালে যে কী বিস্ময় লুকিয়ে আছে, তা কেবল জাদিপাই ঝরনায় গেলেই দেখা যায়। উদ্ধত পাহাড়কে ক্রমাগত ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে তার গায়ে রংধনুর রং এঁকে ঝিরঝির করে ঝরছে জাদিপাই ঝরনা। ঝরনার ওপর পুরো পাহাড়ে অসংখ্য বানরের বসতি। এই ঝরনার কাছে নিজেকে নিতান্তই তুচ্ছ বলে মনে হয়। ঝরনায় যত না কষ্ট করে উঠতে হয়, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হয় এখান থেকে নামতে।
কীভাবে যাবেন
কেওক্রাডং থেকে পূর্ব দিকে পাসিংপাড়ার রাস্তা ধরে কিছুটা হাঁটার পর নামতে হবে নিচের দিকে। একেবারে খাড়া নামতে নামতে সামনে পড়বে জাদিপাইপাড়া। ব্রেক ছাড়া গাড়ির মতো তীব্র বেগে নামতে হবে আরও। একসময় সামনে পড়বে বড় বড় গাছে ঘেরা পুরো সমতল একটা বন। সেই বনের নিচেই লুকিয়ে আছে রহস্যময়ী জাদিপাই ঝরনা।
কেওক্রাডং
কেওক্রাডংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালে মনে হবে গুগল আর্থ দিয়ে দুনিয়া দেখছেন। বড় সুউচ্চ পাহাড়গুলো ঠিক আপনার পায়ের তলে। এর একপাশে রয়েছে দার্জিলিংপাড়া আর অন্য পাশের রাস্তা চলে গেছে বান্দরবানের সর্বোচ্চ জনবসতি পাসিংপাড়ার দিকে। প্রতিদিন ভোরে সূর্যের প্রথম আলো কেওক্রাডংয়ের চূড়া ছুঁয়েই দেখতে পারে মেঘেদের দল গুটিসুটি মেরে পাহাড় জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। সাদা মেঘগুলো খুব ধীরে ধীরে সোনালি রং ধারণ করতে থাকে আর ঘুমের ঘোরে ধাক্কা খেতে থাকে একে অন্যের সঙ্গে। সকাল এখানে ঠান্ডা ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিলেও তারা আবার পুর্ণ্যোদ্যমে দলবলসহ ফেরত আসে সন্ধ্যার পর পরই। কেওক্রাডংয়ে থাকা-খাওয়ার পুরোপুরি ব্যবস্থা আছে।
কীভাবে যাবেন
বগালেক থেকে ঘণ্টা তিনেক বা তারও একটু বেশি হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন কেওক্রাডংয়ে।
বগালেক
বান্দরবানে আকাশছোঁয়া পাহাড়ের ওপর যে নীল ছোঁয়া পানির সমুদ্র রয়েছে, সেই জায়গাটির নাম বগালেক। বগালেকের চারপাশ ঘিরে রয়েছে দুরন্ত সবুজ পাহাড়ের দেয়াল। সূর্য এখানে অনেক দেরি করে ওঠে, তাই এখানকার মানুষ অনেক আরামপ্রিয়। বগালেকের পানি এতই স্বচ্ছ যে এর নিচের অনেকটু দেখা যায়। বগাপাড়ার মানুষজন এই লেকের পানি খাবার পানি হিসেবে নিশ্চিন্তে ব্যবহার করে। এই লেক ঘিরে গড়ে উঠেছে অনেক আজব কথা, যেগুলোর মধ্যে ড্রাগন রাজার গল্পটা সর্বাধিক প্রচলিত। এখানে রাত কাটানোর জন্য যে দোতলা কটেজগুলো রয়েছে, সেখানে ভোরবেলা চোখ খুলে অবাক হয়ে তাকাতে বাধ্য হবেন। যখন বুঝবেন মেঘের মধ্যে বালিশ মাথার নিচে নিয়ে আপনি বিছানায় শুয়ে আছেন। দৃষ্টিসীমা আরেকটু বাড়ালে হতবিহ্বল হয়ে যাবেন, যখন দেখবেন ভোরের আলোকে ছাপিয়ে বগালেকের ঠিক ওপরই হেলতে-দুলতে ভাসছে বিশাল এক রংধনু।
কীভাবে যাবেন
বগালেকে দুভাবে যাওয়া যায়। বাসে ও চান্দের গাড়িতে করে। বান্দরবানের রুমা স্টেশন থেকে পাহাড়িকা বাস ছাড়ে সকাল সাড়ে আটটা, সাড়ে নয়টা ও ১০টায়। সেই বাস কাইক্ষ্যংঝিরিতে পৌঁছালে আপনাকে দৌড়াতে হবে রুমা বাজারে যাওয়ার নৌকা ধরতে। শীতকালে বাস থামে সদরঘাট নামে একটা জায়গায়। রুমা বাজারে নৌকা ভাড়া মাথাপ্রতি ৩০ টাকা। রুমায় নেমে আপনাকে বগালেক যাওয়ার গাইড ঠিক করতে হবে, নাম লেখানো ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে মোলাকাত শেষে দুই হাজার ২০০ টাকায় একটা চান্দের গাড়ি ভাড়া করতে হবে বেলা দুইটার আগেই। দুইটা বেজে গেলে আপনাকে আর যেতে দেওয়া হবে না। রুমাতেই ওই রাত থেকে যেতে হবে। পরের রাস্তাটুকু বেশ মজার, উথালপাতাল বাড়ি খেতে খেতে দুই ঘণ্টা পর চান্দের গাড়িটি যখন আপনাকে বগালেক পাহাড়ের গোড়াতে নামিয়ে দেবে, তখনই বুঝবেন জীবনে বিশ্রাম কতটা আরামের। এই কথাটা আরেকবার মনে হবে, যখন আপনি এই পাহাড় ডিঙিয়ে বগালেকে উঠবেন। রুমা থেকে বগালেক যাওয়ার সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা হলো ঝিরিপথ। পাথুরে ঝরনার পানিতে পা চুবিয়ে চুবিয়ে সাত-আট ঘণ্টা পার করে আপনি যখন বগালেকে উঠবেন, ততক্ষণে পাহাড়ি বুনো সৌন্দর্যের ওপর আপনার পিএইচডি শেষ করা হয়ে যাবে।
নীলগিরি
খুব সকালে মেঘের ওপর হাঁটতে মন চাইলে চলে যেতে পারেন বান্দরবান থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরের নীলাভ পাহাড় নীলগিরিতে। এখানে সেনাবাহিনী পরিচালিত কিছু কটেজ রয়েছে। সেখানে থাকতে হলে অনুমতি নিতে হবে কমপক্ষে ছয় মাস আগে। এ ছাড়া রয়েছে একটি হেলিপ্যাড। যেখানে দাঁড়িয়ে আশপাশের সব পাহাড় নীলের চাদর বিছিয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায়। নীলগিরির পরিবেশ সব সময়ই ঠান্ডা। এঁকেবেঁকে চলা সাঙ্গু নদকে অনেক দূর পর্যন্ত চোখে চোখে রাখতে পারবেন এখান থেকেই।
কীভাবে যাবেন
দুভাবে যাওয়া যায়। বাস অথবা চান্দের গাড়িতে। বান্দরবানের থানচি স্টেশন থেকে পাহাড়িকা বাস ছাড়ে সকাল আটটা, সাড়ে ১০টা, দুপুর ১২টা ও বেলা দুইটায়। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ১৬৫ টাকা। আর যদি চান্দের গাড়ি করে যেতে চান, তাহলে ভাড়া পড়বে চার হাজার ৩০০ থেকে চার হাজার ৫০০ টাকার মতো। একেকটি চান্দের গাড়িতে অনায়াসে ১২ থেকে ১৫ জন আরাম (!) করে বসতে পারবেন।
রিঝুক ঝরনা
পাহাড়ের গা বেয়ে একটানা ঝিরঝির করে সারা বছর সাঙ্গু নদে মিশছে রিঝুকের বরফশীতল পানি। এখানে একসঙ্গে দুই পায়ে দুই রকমের পানির অনুভূতি পাওয়া যায়। সাঙ্গুর গরম পানি এক পায়ে আর অন্য পায়ে রিঝুকের বরফশীতল ছোঁয়া। এই ঝরনার একেবারে কাছে যেতে হলে খুব সাবধানে যেতে হবে। কেননা, রিঝুকের সামনের অংশটুকু এতই নরম যে মুহূর্তেই আপনার কোমর পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে যাবে কাদামাটিতে। বর্ষাকালে নৌকা নিয়ে সরাসরি রিঝুকের নিচে চলে যেতে পারবেন।
কীভাবে যাবেন
আগের সব ধাপ অতিক্রম করে ফেললে রিঝুকে যাওয়া খুব সোজা। রুমা বাজার থেকে যেকোনো নৌকা নিয়ে অনায়াসে দেড়-দুই ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যেতে পারবেন সেই সাদা পানির ঝরনাতে।
থানচি
এখান থেকেই সাঙ্গু নদ তার নিজের রূপে মোহিত করে ভ্রমণপিপাসু মানুষকে। এখানে আকাশের সঙ্গে নদীর সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে। থানচির ভোর বাংলাদেশের আর সব জায়গার ভোর থেকে আলাদা। খুব ভোরে এখানে আপনি মেঘের জন্য কিছুই দেখতে পারবেন না। আস্তে আস্তে বেলা যখন বাড়তে থাকবে, তখন মেঘগুলো আপনার শরীর ছুঁয়ে গ্যাসবেলুনের মতো উঠে যাবে ওপরের দিকে। বান্দরবানের বর্ণিল সৌন্দর্যের প্রবেশদ্বার হলো এই থানচি। ‘থানচি’র অর্থ হলো, বিশ্রামের স্থান।
কীভাবে যাবেন
বান্দরবান শহর থেকে থানচির উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায় সকাল আটটা, সাড়ে ১০টা, দুপুর ১২টা ও বেলা দুইটায়। ভাড়া ১৬৫ টাকা করে। এ ছাড়া চান্দের গাড়ি করে যেতে পারেন। খরচ পড়বে চার হাজার ৩০০ থেকে চার হাজার ৫০০ টাকার মতো। এগুলো ছাড়া আরও একটি লুকানো রাস্তা আছে থানচি যাওয়ার। সেটা শুধু হাঁটাপাগল মানুষের জন্য। সে ক্ষেত্রে বান্দরবান থেকে থানচি আসতে মোটামুটি সাত থেকে দশ দিনের মতো সময় লাগবে।
নাফাখুম
অনেকেই একে বাংলার ‘নায়াগ্রা’ বলেন। এর নাম নাফাখুম। বান্দরবানের এই জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়ালে পাহাড়ি পথে ঝিরির পাশ দিয়ে এবড়োখেবড়ো পিচ্ছিল পাথুরে পথে হেঁটে আসার ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে যায়। পাহাড়ের ওপর থেকে পড়ছে জলরাশি। পুরোটাই শুভ্র, শক্তিশালী। পানি পড়ার সময় যে জলকণা উড়ছে বাতাসে, রোদের বিপরীতে সেগুলো তৈরি করছে রংধনু।
নাফাখুম দর্শনে যেতে প্রথমে যেতে হবে বান্দরবান। এরপর জিপে বা চান্দের গাড়িতে করে ৭৬ কিলোমিটার দূরের থানচি। থানচি থেকে শুরু হবে সাঙ্গু (শঙ্খ) নদী বেয়ে রেমাক্রি বাজার পর্যন্ত যাত্রা। থানচি থেকে প্রথমে তিন্দু, তারপর রেমাক্রি বাজার। রেমাক্রি থেকে শুরু হবে হাঁটা। রেমাক্রি বাজারে সাঙ্গু বাঁক নিয়েছে। এই বাঁকে এসে পড়েছে রেমাক্রি খাল। খালের শুরুটা নাফাখুম জলপ্রপাতে। এই খাল ধরেই হেঁটে যেতে হবে নাফাখুম পর্যন্ত। যাওয়া-আসা মিলিয়ে হাঁটতে হবে সাত-আট ঘণ্টা। নাফাখুম যেতে স্থানীয় গাইড সঙ্গে নেওয়া ভালো।
মিলনছড়ি
মিলনছড়ির মূল আকর্ষণ শৈলপ্রপাত আর তার পাশে ত্রিপুরা গ্রাম। থাকার জন্য রয়েছে গাইড ট্যুরসের ইকো কটেজ। অসাধারণ আতিথেয়তা আর মুখরোচক খাবারের পাশাপাশি পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে যাওয়া শণের ঝুপড়িঘর আপনাকে আপন করে নেবে।
কীভাবে যাবেন
বান্দরবান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে মিলনছড়ি যেতে পারেন। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৩০ টাকা। আর অটোরিকশায় গেলে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। তবে হাঁটা ভালো। বান্দরবান শহর থেকে মাত্র ২ দশমিক ৫ কিলোমিটার।