বাঘের বাড়ি হাড়বাড়িয়া

বাঘের বাড়ি হাড়বাড়িয়া

hatbariaবাঘের রাজ্যে সবুজ রং কত রকমের হতে পারে? গাঢ় সবুজ, হালকা সবুজ, উড়ন্ত সবুজ, ভাসমান সবুজ, অদৃশ্যমান সবুজ…। কোনো সবুজ মনে এনে দেয় প্রশান্তির ছায়া, কোনো সবুজে উচ্ছ্বাস ভেসে বেড়ায় চোখের চারপাশে আর অগণিত সবুজের মিছিল স্তব্ধ করে দেয় ইন্দ্রিয়ের অবাক হওয়ার ক্ষমতাকে। ওই সবুজের বুক চিরে যখন সাদা বক ডানা মেলে দেয়, তখন আনমনেই হাত চলে যায় ক্যামেরার দিকে। এ রকম হাজার রঙের সবুজের ভিড়ে হারিয়ে যেতে আমরা গিয়েছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন, কমলা-কালো ডোরাকাটা বাঘের অভয়ারণ্য সুন্দরবনে।
সাগরছোঁয়া নদীগুলোর জোয়ার-ভাটায় প্রতিনিয়ত দুলছে গাছের ছায়া, শনশন বাতাসে মায়া ভেসে বেড়ায় বনের প্রতিটি প্রান্তে। এই বনে ভয় আছে, আছে আতঙ্ক, আছে রহস্য-রোমাঞ্চমিশ্রিত ভালোবাসা। হরিণের ছুটে চলা পালের মতোই অস্থির মৌমাছির ঝাঁক। তবে একটা প্রাণীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেছি, সেটি হলো মদনটাক। জ্ঞানী মানুষের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে জোয়ার-ভাটা দেখে দিন পার করে দেয় পাখিটি।
সুন্দরবনের ভেতরে ঢোকার প্রথম সুযোগ করে দেয় ‘সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট’-এর ইকবাল হোসাইন। সঙ্গে ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এ আজিজ। এই প্রজেক্টটি প্রতি দুই বছর পরপর সুন্দরবনের ভেতরে ‘খাল সার্ভে’ নামক একটি সার্ভে করে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো, সুন্দরবনের বাঘের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা, দুই বছরে বাঘের সংখ্যার কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না, তা দেখা। বনের ভেতরের অংশটুকু দেখার এমন সুযোগ হেলায় হারানো উচিত নয় ভেবে আমি ঢুকে পড়লাম তাঁদের দলে। ভুল করিনি, সুন্দরবনের এই রূপ কখনোই বাইরে থেকে দেখা সম্ভব নয়।
চোখের সামনে কুমিরের দুই চোখ উঁচু করে আগন্তুকদের দেখা, পাশ দিয়ে বানরের গাছ নাড়ানো, সাপের সর সর শব্দে সরে যাওয়া—ঘণ্টার মতো অবিরাম টিং টিং করে দুলতে থাকা শূকরের লেজ আমাদের জানিয়ে দিল, এ তো সবে শুরু, ওয়েলকাম টু দ্য জঙ্গল!
সাত দিনের খাল সার্ভেতে একবারও মনে পড়েনি শহুরে যান্ত্রিকতার কথা। খালের মধ্যে সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্টের বোট ‘ছাপরাখালী রানী’তে আমরা যখন রাত কাটানোর জন্য ছাদে বিছানা করতাম, তখন বনের দুই পাশ আলো করে জ্বলত লাখ লাখ জোনাকি পোকা। এই জোনাকিগুলো অদ্ভুত, প্রতি তিনটা গাছ পরপর এরা একটা গাছে সবাই মিছিলের মতো জড়ো হয়ে মিট মিট করে জ্বলে, যে গাছটা দেখতে অবিকল ক্রিস্টমাস ট্রির মতো লাগে। পাশের বাকি তিনটা গাছ পুরো অন্ধকারাচ্ছন্ন। পুরাই আজিব। অবাকের ঘোর কাটতে না কাটতেই ঠিক পাশেই পানিতে শুনি ঝপাত্ শব্দ, বাঘ এল নাকি! আতঙ্কে জড়িয়ে ধরি আমার অর্ধেক ওজনের আলম ভাইকে। বুকের ছাতি দুই হাত ফুলিয়ে আলম ভাই ঘোষণা দিলেন, ‘ভয়ের কিছু নাই, জিনিস আছে।’ আড়চোখে তাকিয়ে জিনিস দেখি—একটা স্প্রে আর একটা লাঠি! এগুলোই নাকি বাঘ তাড়ানোর জন্য যথেষ্ট! শীতের মধ্যে শিরদাঁড়া দিয়ে যখন চিকন ঘামের ঝরনা ছুটছে, তখন আজিজ স্যার আশ্বস্ত করলেন, ‘এইটা বাঘ না, কুমির।’ বোটের ড্রাইভার মন্টু ভাই বোট ঘুরিয়ে নিলেন, ‘এই জায়গায় থাকা আর নিরাপদ না, কিছুক্ষণ আগেও কয়েকটা হরিণ ডাকছিল। এখন তাদের ডাক থেমে গেছে, লক্ষণ খারাপ, বাঘ আশপাশেই আছে।’ ইকবাল ভাই ঘোষণা দিলেন, ‘এবার আমরা বাঘের বাড়িতে যাব!’ বাঘ এখানে রাজার মতো হাঁটে, ঘুরে বেড়ায় আপন জগতে, কারও সঙ্গেই তার আত্মীয়তা নেই, তার এলাকায় সে-ই সম্রাট। সেই বাঘের বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছি তার অনুমতি ছাড়া, অবশ্য অনুমতি চাইলেও সেটা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা কস্মিনকালেও নেই। শরীরের অনেক দিনের জমে থাকা অলস রক্ত কি আ্যাাডভেঞ্চারের আশায় একটু লাফ দিল না!
সুন্দরবনের যে কয়টা মনোমুগ্ধকর বড় নদী আছে, সেগুলোর মধ্যে পশুর অন্যতম। দিন-রাত এই নদীর বুকে বিশাল বিশাল জাহাজের আনাগোনা। সেগুলোর পাশে আমাদের বোটটাকে রীতিমতো কাগজের নৌকাই মনে হলো। একেকটা ঢেউ আসে আর আমরা রোলার কোস্টারে চড়া শুরু করে দিই। পশুর নদীর তীরেই হাড়বাড়িয়ার অবস্থান। হাড়বাড়িয়া হলো সুন্দরবনের সবচেয়ে সাজানো-গোছানো ফরেস্ট অফিস। বন বিভাগের এমন সুন্দর অফিস এর আগে আমার নজরে পড়েনি। বেড়ির খালে বোট রেখে আমরা যখন বিশাল উঁচু সিঁড়ি দিয়ে হাড়বাড়িয়ার মাটিতে উঠছি, মনে হচ্ছে খুব আস্তে আস্তে যেন সুন্দরবনের সৌন্দর্য উঁকি দিচ্ছে। ট্যুরিস্টদের জন্য বর্ণিল ছাউনির কথা বাদই দিলাম, বাদ দিয়ে দিলাম সবুজের কোলে বাতাসে হেলতে-দুলতে থাকা ফুলের সাগরের রং-রূপকেও। তার জায়গায় বিস্ময় দখল করে নিয়েছে অসংখ্য ফল-ভর্তি গোলপাতা, গেওয়া ফলের বিশাল সমাহার আর প্রায় ১৫টার মতো মৌমাছির চাক। গোলপাতার নাম কেন গোলপাতা হলো, এটা নিয়ে মনের মধ্যে অনেক দিনই একটা প্রশ্ন ছিল। সেই প্রশ্ন আরও দুর্বোধ্য হয়ে উঠল, যখন দেখলাম এর ফলের আকৃতিতেও গোলাকার বিষয়টার রেশমাত্রও নেই!
‘সুন্দরবন টাইগার প্রজেক্ট’-এর বোটকে বন বিভাগের লোকজন ভালো করেই চেনেন। ফলে আমাদের আর অনুমতির প্রয়োজন হলো না। চারপাশে ব্যাঙের কান জ্বালানো ডাক পেছনে ফেলে কাঠের ব্রিজটা দিয়ে যখন হাড়বাড়িয়ার মূল বনে প্রবেশ করলাম, তখন হঠাত্ করেই খেয়াল করলাম ব্যাঙের ডাক এখানে নেই। কিছুক্ষণ আগে একটা মোরগের হম্বিতম্বি শোনা যাচ্ছিল। সে-ও মুখে কলুপ এঁটে ডুব দিয়েছে তার লুকানো আবাসে। এটা বাঘের রাজ্য, এখানে টুঁ শব্দটা করতে হলেও কলিজা লাগে! পাশের মিজান ভাই আর আলম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বুকে একটু সাহস পেলাম। তাঁরা অনেক দিন ধরেই বাঘ নিয়ে কাজ করেন, গ্রামে ঢুকে পড়া একটি বাঘকে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে উন্মত্ত জনতার হাত থেকে বাঁচিয়ে বনে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছেন তাঁরা। ইঁদুর ও সিংহের গল্প যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের ভয়ের কোনো কারণই নেই। বাঘের এত বড় বন্ধুকে কি সে চিনবে না!
উত্কট একটা ভয়াবহ গন্ধে, নিশ্চিন্দি পালাল। আমার আতঙ্ক দেখে আজিজ স্যার জানালেন, ‘এটা বাঘের শরীর থেকে আসা গন্ধ, বাঘের স্প্রেও বলা যায়। বাঘ যে কয়টা পদ্ধতিতে তার সীমানা নির্ধারণ করে, সেগুলোর মধ্যে এই স্প্রে হলো একটি। আজকের গন্ধটা অনেক বেশি—এর মানে হলো, মামা আশপাশেই আছে।’ তাঁর কথা শুনে আমি তো বিরলভাবে বিস্মিত, চাঁদ মামাকে দেখলে মনের গহিনে কাব্যের উদয় হলেও বাঘ মামাকে দেখলে সেই কাব্য তো কাব্য, কাব্যের মালিকও পালিয়ে দিশা পায় না। যা-ই হোক, বনে যখন ঢুকেছি, তখন ভয় পেলে কি আর চলে, হাজার হোক ‘টাইগার টিমের’ সঙ্গে চলছি। আমাদের প্রথম গন্তব্য ওয়াচ টাওয়ার।
হাড়বাড়িয়ার মূল সৌন্দর্য হলো এই ওয়াচ টাওয়ার, যেটায় উঠলে পুরো হাড়বাড়িয়া একসঙ্গে দেখা যায়। দেখে মনে হবে, যেন বিমান থেকে সুন্দরবন দেখছেন। টাওয়ারটির দুই পাশ দিয়ে বনের ভেতরে ঢোকার জন্য সরকারিভাবেই দুটো রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো দেখে কার না লোভ জাগে বাঘ-হরিণের সুন্দরবনে হারিয়ে যেতে! টাওয়ার থেকে নামার সময় একটু সাবধানে নিচের অংশটুকু দেখেটেখে নামলাম। কথিত আছে, এই টাওয়ারের নিচে নাকি বাঘ বিশ্রাম নিতে আসে। টাওয়ার থেকে নামার সময় একবার যদি মামার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তাহলে তো ঈদ! টাওয়ার থেকে নেমে ডান দিকের রাস্তাটা ধরে হেঁটে যাচ্ছি। বনে ঢোকামাত্র মুহূর্তেই বদলে গেল গাছের দল—এখন এটা আসল সুন্দরবন। যেদিকে তাকাই শুধু সুন্দরী গাছ, মাথার ওপর সুন্দরী গাছের ছায়া, হাতে-গালে ডালের আলতো ছোঁয়া নিমিষেই ভয়ডর সব ঝেঁটিয়ে দূর সাগরে নিয়ে ফেলল। প্রায় দুই কিলোমিটার লম্বা এই রাস্তা মূলত কাঠের একটা সেতু। চোরাই যে সুন্দরী কাঠগুলো বন বিভাগ আটক করে, সেগুলো দিয়েই বানানো হয়েছে নয়নাভিরাম এই পথটি, যাতে করে বনের মাটিতে পা না রেখেও আপনি অনায়াসে ঘুরতে পারেন বিশ্বের সর্ববৃহত্ এই ম্যানগ্রোভ বনে। এ পথ দিয়ে যেতে যেতে আপনার একবারও মনে হবে না যে আপনার ঠিক পেছনেই বাঘ থাকতে পারে। সুন্দরীগাছ নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে লোভনীয় করে। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম, কয়েকটা গাছে বানরের দল অনুসন্ধিত্সু দৃষ্টি নিয়ে আমাদের দেখছে। তাদের দিকে তাকিয়ে আমি বন্ধুসুলভ আন্তরিক একটা হাসি দিলাম, সেগুলোও দাঁত বের করে জবাব দিল। আপাতদৃষ্টিতে আমার কাছে সেটা হাসি মনে হলেও সভ্য সমাজে ওটাকে ভেংচিই বলা হয়ে থাকে। লম্বা এই রাস্তায় মাঝেমধ্যে বিশ্রাম নেওয়ারও নির্দিষ্ট জায়গা রয়েছে। রাস্তার শেষ মাথায় মাটির যে পথটি চলে গেছে বনের ভেতরে, সেদিকে যাওয়া বারণ। মাটির রাস্তায় একটা সাইনবোর্ড দেখে হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারছি না। এত দিন শুধু সাইনবোর্ড দেখতাম ‘কুকুর হইতে সাবধান’, আর এখানে লেখা ‘বাঘ হইতে সাবধান’ !!! সেই লেখার নিচে দুটি বানর বসে বসে কেওড়া ফল চিবুচ্ছে! দুনিয়া বড়ই বিচিত্র। আজিজ স্যার আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘রাতের বেলায় এই রাস্তা দিয়ে বাঘ হাঁটে।’
হাড়বাড়িয়ায় একটা বিশাল পুকুর আছে, পুকুরের ওপর আছে ট্যুরিস্টদের জন্য বিশ্রামের জায়গা, কাঠের ব্রিজ দিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে সেই ছাউনিতে যেতে হয়। নানা রকমের ফুল আর নারকেলগাছে সাজানো শান বাঁধানো এই পুকুরে গোসল করা নিষেধ, কারণ এই পুকুরে বাঘ প্রায় প্রতিদিনই পানি খেতে আসে। আমরাও একটু খেয়ে দেখলাম, মিঠা পানি। ভাগ্য ভালো হলে সুন্দরবনের বিখ্যাত চিত্রা হরিণও নজরে পড়বে আপনার। আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল। সন্ধ্যে হয়ে গেছে ততক্ষণে। ইকবাল ভাই জানালেন, ‘ফিরে যেতে হবে। আমাদের বিচরণের সময় শেষ। সন্ধ্যার পর থেকেই বাঘের বিচরণ শুরু হবে। বাঘ তার নিজের রাজ্যে আর কাউকে সহ্য করতে পারে না।’ আমরা ফিরে এলাম আমাদের বোটে আর পেছনে রেখে এলাম বাঘের বাড়ি—যেখানে বাঘের বিশ্রামের জন্য একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে, আছে বনের রাজার টহলের জন্য মসৃণভাবে তৈরি কাঠের পথ আর সাজানোগোছানো মিষ্টি পানির পুকুর। বাঘ এখানে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়, এখানকার অলিগলি তার চেনা, এটা তার ঠািকানা।
কীভাবে যাবেন
হাড়বাড়িয়ায় যেতে হলে আপনাকে সবার আগে যেতে হবে সায়েদাবাদ বাস স্টেশনে, সেখান থেকে মংলায় যাওয়ার জন্য ফাল্গুন বাসের টিকিট কেটে ফেলুন, ভাড়া নেবে ৩০০ থেকে ৩৩০ টাকার মতো। ফেরি জটিলতায় না পড়লে সময় লাগবে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। ভোরে মংলায় পৌঁছেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা জালি বোট ভাড়া করে ফেলুন হাড়বাড়িয়ার উদ্দেশে। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিনের জন্য বোট ভাড়া পড়বে ৩৫০০ টাকা থেকে ৫০০০ টাকার মতো। দক্ষ মাঝি নেবেন। হাড়বাড়িয়ায় ঢুকতে হলে বন বিভাগের অনুমতি প্রয়োজন। এক দিনের জন্য গেলে হাড়বাড়িয়া বন অফিস থেকে অনুমতি নিলেই চলবে, কিন্তু দুই থেকে তিন দিনের জন্য ঘুরতে গেলে বাগেরহাটে অবস্থিত ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিস (ডিএফও) থেকে অনুমতি নিতে হবে। নদীতে সাঁতার কাটার ইচ্ছা থাকলে পরিহার করুন, কারণ সুন্দরবন হলো আমাদের পাঠ্যবইয়ের ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’ টাইপের জায়গা। সুন্দরবনে বেড়াতে গেলে একটা কথা সব সময় মাথায়, না না অন্তরে রাখবেন, ‘এই বন আমাদের, এই বনকে নষ্ট করলে আমাদেরই ক্ষতি হবে, আমরা বনের গাছের কোনো ডালও ভাঙব না, বনের কোনো পশুর ক্ষতিও করব না।’
أحدث أقدم