জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে কিভাবে প্রতারনার শিকার হতে পারেন

developer_shutterstock_32578711
আহমাদ সাহেব (ছদ্মনাম) মারা যাওয়ার পর তাঁর ওয়ারিশরা তাঁর সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা পায়। কিন্তু তারা সবাই মিলে মৌখিকভাবে বণ্টন করে নেয়, কে কোন জায়গা পাবে। এভাবে ভোগদখল করার পর একসময় আহমাদ সাহেবের এক ছেলে ভুয়া দলিল তৈরি করে সহ-শরিকদের অংশসহ অন্যদের অজান্তেই বিক্রি করে দেয়। এতে ক্রেতা যখন ভোগদখল নিতে আসে, তখন দলিল জালিয়াতির বিষয়টা ধরা পড়ে।
ঘটনা-দুই
করিম সাহেব ১৯৮০ সালে একখণ্ড জমি কেনেন এবং ক্রয়সূত্রে মালিক হন। মোট জমির পরিমাণ ৫০ শতাংশ। এ থেকে তিনি ১৫ শতাংশ জমি রফিক সাহেবের কাছে বিক্রি করে দেন এবং বাকি ২৫ শতাংশ অন্য একজনের কাছে বিক্রি করেন। কিন্তু করিম সাহেবের কাছ থেকে যে ১৫ শতাংশ জমি কিনেছেন, এতে এখন সিএস খতিয়ান অনুযায়ী ৫ শতাংশের অস্তিত্ব নেই। এতে রফিক সাহেব একটু সতর্ক থাকলে এ ভুলের ফাঁদে পা দিতেন না। (ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে)
জমিজমা কেনার আগে কিছু বিষয়ে অবশ্যই ক্রেতাকে সাবধান হতে হয়। জমিজমা নিয়ে ঝামেলার শেষ নেই। জমি ক্রয় করতে চাইলে অবশ্যই কিছু বিষয়ে খেয়াল না রাখলে স্বপ্নের জমি দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে যেতে পারে। একখণ্ড জমি কিনতে গিয়ে হয়ে যেতে হবে সর্বস্বান্ত।
জমি কেনার আগে জমির ক্রেতাকে জমির বিভিন্ন দলিল বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে, জমির মালিকের মালিকানা বৈধতা ভালো করে যাচাই করতে হবে। মাঝেমধ্যে দেখা যায়, একজনের নামের জমি অন্য একজন ভুয়া দলিল দেখিয়ে বিক্রি করেছে। পরে আসল মালিক ক্রেতাকে জড়িয়েও মামলা ঠুকে দেয়। যে ব্যক্তি জমিটি বিক্রয় করবে ওই জমিতে বিক্রয়কারীর জমির মালিকানা আছে কি না, প্রথমে সে বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে। এ জন্য প্রস্তাবিত জমিটির সর্বশেষ রেকর্ডে বিক্রয়কারীর নাম উল্লেখ আছে কি না। সিএস, আরএসসহ অন্যান্য খতিয়ানের ক্রম মিলিয়ে দেখতে হবে।
জমির বিভিন্ন প্রকার দলিল থাকতে পারে। বিক্রীত দলিল থেকে শুরু করে ভূমি উন্নয়ন কর, খতিয়ান সবই হচ্ছে দলিল। ক্রেতাকে প্রথমেই দেখতে হবে সব শেষে যে দলিল করা আছে, তার সঙ্গে পূর্ববর্তী দলিলগুলোর মিল আছে কি না। বিশেষ করে, ভায়া দলিলের সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কি না, দেখতে হবে। ভায়া দলিল হচ্ছে মূল দলিল, যা থেকে পরের দলিল সৃষ্টি হয়। ধরা যাক, মাসুদ সাহেব কিছু জমি ১৯৮০ সালে ৩৭৭ নম্বর রেজিস্ট্রি দলিলের মাধ্যমে কেনেন। সেই জমি ২০০৭ সালে অন্য একজনের কাছে ২৭০ নম্বর রেজিস্ট্রি দলিলে বিক্রি করলেন। তাহলে আগের ৩৭৭ নম্বর দলিলটি হচ্ছে ভায়া দলিল। হস্তান্তরকৃত দলিলে দাতা এবং গ্রহীতার নাম, ঠিকানা, খতিয়ান নম্বর, জোত নম্বর, দাগ নম্বর, মোট জমির পরিমাণ ভালো করে দেখতে হবে। আরেকটি বিষয় খেয়াল করতে হবে, যে ভায়া দলিল থেকে পরবর্তী দলিল করা হয়েছে, তাতে প্রতি দাগের হস্তান্তরিত জমির পরিমাণ কম না বেশি। অনেক সময় আগের দলিলের চেয়ে পরের দলিলে বেশি জমি দেখানো হয়। জমিটি যদি বিক্রেতা অন্য কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে ক্রয় করে থাকে, তাহলে অবশ্যই তাকে এ জমির ভায়া দলিল রেজিস্ট্রেশনের সময় উপস্থাপন করতে হবে। ভায়া দলিল যদি বিক্রেতার সংগ্রহে না থাকে, তাহলে এ দলিল থানা ভূমি রেকর্ড অফিস থেকে ওঠানো যাবে। যদি থানা ভূমি অফিসে না পাওয়া যায়, জেলা ভূমি রেকর্ড অফিস থেকে তোলা যাবে।
মিউটেশন বা নামজারির মাধ্যমে যে খতিয়ান তৈরি করা হয়েছে, সে অনুযায়ী খতিয়ানে হস্তান্তরিত দাগের মোট জমির পরিমাণ এবং দাগের অবশিষ্ট পরিমাণ যোগ করতে হবে। এই যোগফল কোনো দাগে মোট যে পরিমাণ জমি আছে, তার চেয়ে কম না বেশি, তা দেখতে হবে। যদি বেশি হয়, তাহলে অতিরিক্ত জমির মালিকানা কোনোভাবেই দাবি করা যাবে না। নামজারি যদি না হয়, তাহলে কেন হয়নি, তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। নামজারির মাধ্যমে জোত নম্বর খোলা না হলে এতে পরবর্তী সময়ে ঝামেলা হয়।
জমিটির হালনাগাদ ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। ভূমি কর না দেওয়ার কারণে কোনো সার্টিফিকেট মামলা আছে কি না, এই বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে। জমিটির ওপর অন্য কোনো মামলা আছে কি না, জেনে নিতে হবে।
বিক্রয়কারী ওয়ারিশসূত্রে জমির মালিক হয়ে থাকলে বণ্টনের মোকদ্দমা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। জমিতে ওয়ারিশদের কোনো অংশ থাকা না থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। যদি জমিটি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়ে থাকে, তাহলে বণ্টননামায় জমি দখলের কথা উল্লেখ থাকার বিষয়টি দেখতে হবে। কৃষিজমির ক্ষেত্রে অংশীদারিরা ও পার্শ্ববর্তী ভূমির মালিকেরা অগ্র-ক্রয়াধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এ ছাড়া মুসলিম আইন অনুযায়ী কোনো অগ্রক্রয়ের মামলা আছে কি না, খোঁজ নিতে হবে।
বিক্রয়ের জন্য প্রস্তাবিত জমিটি বিক্রয়কারীর দখলে থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। এ জন্য সরেজমিনে নকশার সঙ্গে জমিটির বাস্তব অবস্থা মিলিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে পার্শ্ববর্তী ভূমি-মালিকদের কাছ থেকে দাগ ও খতিয়ান নম্বর জেনে মিলাতে হবে।
প্রস্তাবিত জমির সঙ্গে সরকারের খাসজমি আছে কি না, কিংবা সরকারের কোনো স্বার্থ থাকার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। জমিটি অর্পিত সম্পত্তি কিংবা পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকায় আছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। জমিটি আগে কোনো সময়ে অধিগ্রহণ হয়েছে কি না বা প্রক্রিয়াধীন কি না, ওয়াক্ফ, দেবোত্তর অথবা কোর্ট অব ওয়ার্ডসের জমি কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে। জমিটি কখনো খাজনা অনাদায়ের কারণে নিলাম হয়েছে কি না, ঋণের জন্য জমিটি কোনো ব্যাংকের কাছে বন্ধক আছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে। জমিটি এর আগে অন্য কারও কাছে বিক্রি করেছে কি না, খোঁজ নিতে হবে। রেজিস্ট্রি অফিস থেকে জমিটির দাম ও বেচাকেনার সর্বশেষ তথ্য জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
জমিটির মালিক কোনো আমমোক্তার বা অ্যাটর্নি নিয়োগ করেছে কি না, জেনে নিন। বিক্রেতা যদি আমমোক্তারনামার মাধ্যমে ক্ষমতা পেয়ে থাকে, এর বৈধতা যাচাই করতে হবে। প্রকৃত মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে হবে প্রকৃত মালিক যথাযথ কি না এবং আমমোক্তারটি যথাযথ হয়েছে কি না। ২০০৫ সাল থেকে নতুন ফরমেট বা ছকবদ্ধ আকারে জমির বিক্রয় দলিল সম্পাদন করার নিয়ম চালু হয়েছে। ২০০৮ সালে এটি সংশোধিত আকারে এসেছে। এখন থেকে সব হস্তান্তরিত দলিল এই ফরমেট আকারে করতে হবে। এতে জমি পূর্ববর্তী ন্যূনতম ২৫ বছরের মালিকানার ধারাবাহিক বিবরণ উল্লেখ করতে হয়। জমি কেনার সময় অবশ্যই এই বিবরণের সঙ্গে বাস্তব অবস্থা মিলিয়ে দেখতে হবে।
সূত্রঃ প্রথম আলো
أحدث أقدم