হাত বাড়ালেই মেঘ

হাত বাড়ালেই মেঘ

ganting-highlandকেব্ল কারে যতই ওপরে উঠছি, ততই বুক কাঁপছে দুরু দুরু।কাঁপুনি আরও বাড়িয়ে দিতে মাঝেমধ্যে কারটি দোলা দিচ্ছে। একে তো কেব্ল কার ওপরে উঠছে তার মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। প্রায় ৪৫ মিনিটের পথ বেয়ে ওপরে উঠে গ্যানটিং হাইল্যান্ডে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিমেল বাতাসে জড়সড় হওয়ার অবস্থা। উপায় না দেখে পাশেই কাপড়ের দোকানে ঢুকে আমরা কয়েকজন জ্যাকেট, সোয়েটার কিনে শরীরে জড়ালাম। কিছুক্ষণ পরই আবার গরম লাগতে শুরু করল। সবাই শীতের কাপড় খুলে ফেললাম। বাংলাদেশে যে শীতের কাপড়টি দেড় শ টাকায় পাওয়া যায়, সেটি প্রায় এক হাজার ২০০ টাকায় কিনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
৩১ আগস্ট ছিল মালয়েশিয়া দেশটির স্বাধীনতার ৫২তম বার্ষিকী। ওয়ান মালয়েশিয়া স্লোগানকে সামনে রেখে এবার স্বাধীনতার ৫২তম বার্ষিকী উদ্যাপন করছে দেশটি।এই বার্ষিকীর অনুষ্ঠান ‘মারদেকা’র সঙ্গে মিল রেখে ট্যুরিজম মালয়েশিয়ার আমন্ত্রণে বাংলাদেশসহ ২৪টি দেশের ১৯৪ জন সাংবাদিক ও ট্রাভেল এজেন্ট জড়ো হন সেখানে। এই দলেই ছিলাম আমি।
প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নানা সাজে অপরূপভাবে পর্যটকদের সামনে হাজির করা হয়েছে আধুনিক মালয়েশিয়াকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যাওয়া পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ গ্যানটিং হাইল্যান্ড। এখানে ছয় হাজার ফুট উঁচুতে রয়েছে ফাস্ট ওয়ার্ল্ড হোটেলসহ একই মালিকানায় ছয়টি হোটেল। ফাস্ট ওয়ার্ল্ডের ছয় হাজার ১১৮টি সহ ছয়টি হোটেলে প্রায় ১০ হাজার ঘর রয়েছে গ্যাংটিং হাইল্যান্ডে। সড়কপথে মাত্র পৌনে এক ঘণ্টায় কুয়ালালামপুর থেকে গ্যানটিং যাওয়া যায়। এখানে থিমপার্ক, পাব, বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড পণ্যের দোকানসহ—সব আয়োজনই পাহাড়-চূড়ায়। ২৮তলা ফাস্ট ওয়ার্ল্ড হোটেলের ২৫তলার জানালা খুলে মেঘকে ছোঁয়া যায়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য মনে রাখার মতো। বিশ্বের দীর্ঘতম কেব্ল কারওয়ে রয়েছে এ পাহাড়ের চূড়াতেই। যাঁরা কেব্ল কারে উঠতে আপত্তি করেন, তাঁদের জন্য রয়েছে সাপের মতো পেঁচানো সরু পিচঢালা পথ।
গর্বের প্রতীক পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার মালয়েশিয়ার গর্ব ৪৫২ মিটার উঁচু পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, কুয়ালালামপুরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বের আধুনিক এই টাওয়ারই মালয়েশিয়ার আধুনিক স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন। এটা তাদের গর্বের প্রতীক। অদূরেই আছে ৪২১ মিটার উঁচু কেএল টাওয়ার। টুইন টাওয়ার ও কেএল টাওয়ার দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য একটা আকর্ষণীয় ভবন। রাতে টুইন টাওয়ারের ভবনজুড়ে দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জা সবার নজর কাড়ে। কেএল টাওয়ার পুরো কুয়ালালামপুর শহরটিই দেখা যায়। কয়েক শ বিদেশি পর্যটক প্রতিদিন যান সেখানে। কুয়ালালামপুর শহরটিকে ভালোভাবে দেখার জন্য টাওয়ারের ভেতরের বিভিন্ন অংশে স্থাপন করা হয়েছে দুরবিন। শুধু সৌন্দর্য বিকাশই নয়, টুইন টাওয়ার ও কেএল টাওয়ার থেকে মালয়েশিয়া সরকার প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা আয় করছে পর্যটকদের কাছ থেকে।
কুয়ালালামপুরের দিগন্তরেখা অনেক বদলে গেছে গত ৫২ বছরে। অল্প সময়ের মধ্যে পর্যটনে মালয়েশিয়া বহু এগিয়েছে। রাজধানী কুয়ালালামপুর, পাহাড়ের চূড়ার গ্যানটিং হাইল্যান্ড আর দ্বীপ শহর পেনাংয়ে ঘুরেফিরে কত দ্রুত সময় চলে যায়, তা টেরই পান না পর্যটকেরা।
মালয়েশিয়ার রাস্তাঘাটের প্রশস্ততা, ফ্লাইওভার, মনোরেল সবকিছুই জানান দেয় এগিয়ে গেছে মালয়েশিয়া। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন্নতা মালয়েশিয়ার আরেকটি বড় বিষয়। সর্বত্র ছিমছাম ভাব। আর রাত হলেই দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জা।
কেনাকাটার জন্য পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ ‘মাইডিন’ নামের একটি শপিং মল। মালয়েশিয়ায় বড় ও ভালো মানের হোটেল আছে এক হাজার ৯৮৯টি। এর মধ্যে রাজধানী কুয়ালালামপুরে আছে ১৭৫টি হোটেল, যাতে কক্ষসংখ্যা ২৬ হাজার।
পর্যটকদের জন্য মুখরোচক খাবারও পাওয়া যায় সহজে।মালয়ী, চীনা, সামুদ্রিক খাবার, ভারতীয় বা দক্ষিণ ভারতীয় খাবারের স্বাদ নেওয়া যায় কুয়ালালামপুর, গ্যানটিং হাইল্যাল্ড আর পেনাংয়ের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়।
সর্বত্র মালয়েশিয়াকে তুলে ধরার আয়োজন আছে চোখে পড়ার মতো।
পেনাংয়ের প্রজাপতির খামার, ট্রপিক্যাল স্পাইস গার্ডেন পরিদর্শন ও বাটু ফিরিঙ্গি বিচে সকাল-বিকেল কাটানো—সবকিছুই পর্যটকদের আনন্দের জন্য। পেনাং দ্বীপকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু তৈরি করা হয়েছে, সত্যিই যা দেখার মতো। দ্বিতীয় সেতুর কাজ চলছে, যা হবে প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ।
দেখার মতো রাতের শহর
কুয়ালালামপুর, গ্যানটিং বা পেনাংয়ের রাতও দেখার মতো। বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির আগের রাতে মনে হয় কেউই বুঝি ঘরে থাকে না।সারা রাত জেগে থাকে পুরো কুয়ালালামপুর। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী গাড়ি ও মোটরসাইকেল নিয়ে নেমে পড়ে রাস্তায়। পাঁচতারকা থেকে শুরু করে রাস্তার ধারের হোটেল সবখানেই গমগম করে ট্যুরিস্ট ও স্থানীয় মালয়েশিয়ান লোকজনের সমাগমে। একই অবস্থা পেনাংয়ে।
বেশি আকৃষ্ট করছে এশীয়দের
রাজধানী কুয়ালালামপুরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেই মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের সারি সারি বিমান দেখে বুঝতে বাকি থাকে না যে তাদের পর্যটন শিল্প বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের রয়েছে শতাধিক বিমান। মালয়েশিয়ায় বিমানবন্দর রয়েছে ২০টি, যার অধিকাংশই আন্তর্জাতিক।
মালয়েশিয়ার ট্যুরিজম মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা পরিসংখ্যান তুলে ধরেন, কীভাবে প্রতিবছর মালয়েশিয়ায় পর্যটকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার পর্যটকের সংখ্যা সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে। ভালো পরিবেশ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং পারিবারিক পরিবেশে ছুটি কাটানোর উপযোগী পরিবেশ আছে বলে মালয়েশিয়াকে অনেকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেয়।
দৃষ্টিনন্দন মনোরেল ও ফ্লাইওভার
৫২ বছর আগে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ মালয়েশিয়া। রাজধানী কুয়ালালামপুর ছিমছাম। ওপর দিয়ে চলছে মনোরেল। নিচ দিয়ে ট্রেন-বাস। কিছু কিছু এলাকায় চার থেকে পাঁচটি ফ্লাইওভার। পুরো কুয়ালালামপুরেই উন্নয়নের ছোঁয়া দেখা যায়। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে কুয়ালালামপুর কনভেনশন সেন্টারে গড়ে তোলা হয়েছে ‘অ্যাকুরিয়া কেএলসিসি’। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা জীবন্ত মাছ রাখা হয়েছে এখানে স্থাপন করা অ্যাকুরিয়ামে। টাইগার শার্কও রয়েছে এখানে। রয়েছে ব্যাঙ, সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির জীব। ৯০ মিটার লম্বা টানেল রয়েছে, যার ভেতর দিয়ে পর্যটকেরা হেঁটে বা চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে চলাচল করতে পারে। টানেলের মাথার ওপর হাঙর ভেসে চলছে, ডানে-বাঁয়ে সব সামুদ্রিক মাছ।
আজকাল অনেকেই দেশের মধ্যে তো বটেই, দেশের বাইরে যাচ্ছে বেড়াতে। মালয়েশিয়া ঘুরে আসার নানা রকম প্যাকেজ ট্যুরের খবর প্রায়ই পাওয়া যায়। মালয়েশিয়ার বিমান সংস্থা, কোনো পর্যটন সংস্থা বা বেসরকারি সংস্থাগুলো এসব ভ্রমণের আয়োজন করে থাকে।মালয়েশিয়া যাঁরা বেড়াতে যেতে চান তাঁরা পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে এসব প্যাকেজ আয়োজনের খোঁজ পেতে পারেন।
أحدث أقدم