বাঘ দর্শনে সুন্দরবনে
ঋতুভেদে সুন্দরবন বারবার রূপ পাল্টায়। যখনই অবকাশ মেলে, চলে যাই সুন্দরবন ভ্রমণে; বাঘ দেখার একটা আশা তো থাকেই। বহুবার বহু মানুষের মুখে শুনেছি, সামনাসামনি বাঘ দেখলে শরীর পাথর হয়ে যায়, কথা বলার শক্তি থাকে না। আমিও বহুবার আশা করেছি, কোনো একদিন বাঘের দেখা পাব; কিন্তু সে সৌভাগ্য ঘটেনি অনেক দিন। ধরেই নিয়েছিলাম, বাঘ দেখার মুহূর্ত আমার জীবনে আর আসবে না, কিন্তু সেটাও এল। সেই গল্প দিয়েই শুরু করি লেখাটা
সেবার চার-পাঁচ দিন সুন্দরবনে ঘুরে ফেরার সময় হলো। ভেবেছিলাম, এবারও বাঘের সঙ্গে দেখা হবে না। অনেকের মধ্যে সেবার সঙ্গী হয়েছিলেন সাংবাদিক নঈম তারিক ও শিল্পী আ হা চঞ্চল। এটা ছিল তাঁদের প্রথম সুন্দরবন দর্শন। সুন্দরবনে রওনা হওয়ার আগে থেকেই বলছিলেন, বাঘ তাঁরা দেখবেনই। আমি মুচকি হাসতাম। সেই ১৯৭৩ সাল থেকে খসরু চৌধুরী (যিনি ‘বাঘ খসরু’ নামেই পরিচিত) সুন্দরবন ভ্রমণ করছেন, কিন্তু বাঘের দেখা পেয়েছেন প্রায় এক যুগ পর। আমিও ১০-১১ বার এসেছি, কিন্তু বাঘের পায়ের ছাপ আর বিষ্ঠা ছাড়া কিছুই দেখিনি। কিন্তু চঞ্চলের বিশ্বাস ভঙ্গ করতে ইচ্ছে হলো না। তিনি তাঁর বিশ্বাসে অটল। আমি বরং রসিকতাই করছিলাম। হঠাৎ কোনো বাঁদর দেখলেই বলতাম, ‘চঞ্চল, দেখেন, বাঘ!’
ফিরে আসার দিন লঞ্চে আমি আর নঈম আড্ডা দিচ্ছি। শেল্লা নদী দিয়ে চলেছে লঞ্চ। চঞ্চল হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘বাঘ! বাঘ!’
আমরা ভাবলাম রসিকতা, কিন্তু তখন লঞ্চের সবাই হুড়মুড় করে ছুটে চলেছে চঞ্চলের দিকে। আমরাও গেলাম। দেখলাম, একটি ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার নদীর এপার থেকে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু লঞ্চে মানুষের চিৎকার শুনে নদীতেই একটু থমকে দাঁড়াল। তারপর ফিরে গেল সেই পথে, যে পথে রওনা হয়েছিল। এরই মধ্যে সবার হাতের ডিজিটাল ক্যামেরা ক্লিক ক্লিক করে উঠল। কিন্তু ছোট ডিজিটাল ক্যামেরায় কি আর দূরের বাঘের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে! আমরা তাই খুঁজতে লাগলাম আলোকচিত্রী জাকির হোসেনকে। তাঁর আছে পেশাদারি ক্যামেরা। তিনি তখন স্নানপর্ব সারছেন। আমরা তাঁকে টেনেটুনে স্নানঘর থেকে বের করলাম। খালি গায়েই তিনি চলে এলেন। ক্যামেরায় টেলিলেন্স লাগিয়ে বাঘের ছবি তুললেন। এই ছবি আমাদের সংগ্রহে না থাকলে কে বিশ্বাস করত, আমরা নিজের চোখে বাঘ দেখেছি?
এ ছাড়া আরও কত গল্প আছে সুন্দরবন নিয়ে! যেমন, একবার মৌমাছির খোঁজে গিয়ে দলবলসুদ্ধ মৌমাছির কামড় খাওয়ার কথাও মনে আছে। কামড় খেয়ে দুজনের তো হাসপাতালে স্থান করে নিতে হয়েছিল।
অবকাশের জন্য সুন্দরবনের চেয়ে ভালো জায়গা আর নেই। নিসর্গ উপভোগ করা, লঞ্চ থেকে নেমে নৌকায় সূর্যোদয় দেখা, কুমির, বাঁদর, হরিণ, সাপ, হাজারো পাখি প্রভৃতি দেখার আনন্দই আলাদা। খুলনা-মংলা হয়ে সুন্দরবন যাওয়া যায়; মংলা থেকে কিছুদূর গেলেই শুরু হয়ে যায় সুন্দরবন।এর পরই কচিখালী হয়ে যাওয়া যায় কটকা পর্যন্ত।আবার সাতক্ষীরার বুড়ি গোয়ালিনী দিয়ে, জামতলা হয়েও যাওয়া যায়। দূরের গন্তব্য কটকা বা হিরণ পয়েন্ট।সুন্দরবন গেলে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন হলো প্রাণীদের এলাকা, তাদের বিরক্ত করা একেবারেই উচিত হবে না।