সাকুরা ফুলের দেশে

সাকুরা ফুলের দেশে

Sakuraপ্রথমবার
পি আর প্লাসিড সাহিত্যপ্রেমী যুবক। বহুদিন হয় সে জাপানে থাকে। বিবেকবার্তা নামে ছোট্ট একটা কাগজ করে। ২০০৪ সালের শুরুর দিকে সে আমার ফ্ল্যাটে এল। সঙ্গে অতি লম্বা, বয়স্ক এক জাপানি ভদ্রলোক আর প্লাসিডের অতি ক্ষুদ্র ছেলেটি। নাম থাইয়ো। তখন থাইয়োর বয়স তিন সাড়ে তিন হবে। কিন্তু চঞ্চলতায় তার বয়স হাজার খানেক। সেদিনের আগে এত চঞ্চল বাচ্চা আমি আর দেখিনি। আধাঘণ্টা খানেকের মধ্যে সমস্ত ফ্ল্যাট তছনছ করে ফেলল। একদিকে থাইয়ো আমার ফ্ল্যাট তছনছ করছে, অন্যদিকে খুবই নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে প্লাসিড আমার সঙ্গে কথা বলছে। এপ্রিলে টোকিওতে বৈশাখী মেলা হচ্ছে কয়েক বছর ধরে। জাপানপ্রবাসী বাঙালিরা একত্র হয়ে করে। সেখানে সে একটা বইয়ের স্টল করবে এবং বিবেকবার্তার পক্ষ থেকে আমাকে একটা পুরস্কার দেবে। আমি যেতে রাজি আছি কি না, পুরস্কার গ্রহণে রাজি আছি কি না এটা জানার জন্য তার সপুত্র দেশে আগমন। আমার রাজি না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
এপ্রিলের ১৫ তারিখে টোকিও পৌঁছে গেলাম। প্লাসিড আমাকে নিয়ে তুলল টুলুর বাড়িতে। সে থাকে মিকুরা এলাকায়। জাপানি স্ত্রীর নাম ওগাহারা আখিকো। পাঁচ বছর বয়সী ছেলেটির নাম হিরোকি। না, এই বাচ্চাটি শান্ত।
বৈশাখী মেলা ১৭ তারিখে। মাঝখানে একটা ফাঁকা দিন। টুলু আমাকে অমিয়া এলাকায় নিয়ে বিখ্যাত হিকাওয়া জিনজা (টেম্পল) দেখাল। সাকুরা বাগানে নিয়ে গেল। তখনো কোনো কোনো গাছে ফুটে আছে সাকুরা, জাপানের বিখ্যাত ফুল। ছোট এবং বড় করা যায়, সাইতামা এলাকার সিনথোসি স্টেডিয়ামটি হচ্ছে তেমন। টুলু আমাকে সেই স্টেডিয়াম দেখাল। পুরোটা দিন আমরা ঘুরেই কাটালাম। বিকেলের দিকে প্লাসিড এসে যোগ দিয়েছিল।
পরদিন বৈশাখী মেলা। মেলা হচ্ছে ইকেবুকোরো এলাকার নিশিগুচি পার্কে। প্লাসিডের জাপানি বউ ইউকি আমাদের নিয়ে গেল। সঙ্গে থাইয়ো আছে। ছেলেটি এত শার্প, আমার চেহারা মনে রেখেছে। দৌড়ে এসে আমার প্যান্ট টেনে ধরল। ধরল এত আন্তরিক ভঙ্গিতে কিন্তু আমি ভয় পেয়ে গেলাম। যাব্বাবা, টেনে খুলে ফেলবে নাকি!
নিশিগুচি পার্কে বৈশাখী মেলাটি সেবার বিশাল আয়োজনে হলো। জাপানের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালিরা এসেছে। টোকিওর মেয়র আছেন। তাঁর সঙ্গে আছে অনেক জাপানি গণ্যমান্য ব্যক্তি। আমাদের রাষ্ট্রদূত আছেন। পরিচয় হলো, কিন্তু তিনি আমাকে পাত্তাই দিলেন না। মনটা একটু খারাপই হলো।
সেবার দুই সপ্তাহ থাকলাম জাপানে। জাপানপ্রবাসী কবি, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক-অনেকের সঙ্গে পরিচয় হলো। সেবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো, যেখানে বৈশাখী মেলা হয়, সেই পার্কে একটা শহীদ মিনার তৈরির প্ল্যান করেছে বাঙালিরা। মেয়রের অনুমতির চেষ্টা চলছে। শহীদ মিনারের একটা মডেলও তৈরি করেছেন একজন বাঙালি আর্কিটেক্ট। শহীদ মিনারসংক্রান্ত একটা মিটিংয়ে আমি একদিন ছিলাম। ভাবতে ভালো লাগছিল যে আমাদের ভাষাশহীদদের ্নৃতির উদ্দেশে শহীদ মিনার হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম এক শহর টোকিওতে। স্বপ্ন শেষপর্যন্ত স্বপ্নই থেকে যাবে কি না কে জানে। না, আমাদের সেই স্বপ্ন স্বপ্ন থাকেনি। বাস্তবায়িত হয়েছে। টোকিওর ইকেবুকোরো এলাকার নিশিগুচি পার্কে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই শহীদ মিনারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে নিজেদের জন্য গর্ব হয়।
সেবার ‘বিবেকবার্তা পুরস্কার’ দেওয়া হলো দুপুরবেলা টোকিওর এক রেস্টুরেন্টে। মনজুরুল হকের হাত থেকে নিলাম। একদিন বিকেলবেলা এনএইচকেতে গেলাম। এনএইচকে রেডিওর জন্য মনজু ভাই আমার একটা সাক্ষাৎকার নিলেন। ফেরার সময় প্লাসিড আর আমি হাঁটছি। হেঁটে হেঁটে টোকিওর বিকেল দেখছি। বিশাল এক হোটেলের সামনের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হোটেলের নাম অ্যানা (অঘঅ)। কেন যে হোটেলটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, এই হোটেলে যদি একটা রাত অন্তত কাটানো যেত! কোনো কারণ নেই, তবু মনে হলো। দ্বিতীয়বার জাপানে গিয়ে এই হোটেলেই আমাকে উঠতে হয়েছিল। আশ্চর্য এক স্বপ্নপূরণ।
তাকেশি কাইকো স্মারক বক্তৃতা
১৯৩০ সালে পশ্চিম জাপানের ওসাকা শহরে জন্মেছিলেন তাকেশি কাইকো। এই লেখক তাঁর লেখালেখির জন্য যতটা বিখ্যাত, তাঁর বলিষ্ঠ রাজনৈতিক অবস্থানের জন্যও ততটাই বিখ্যাত। জাপানি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দুই স্বীকৃতি আকুতাগাওয়া সাহিত্য পুরস্কার এবং মায়নিচি সাহিত্য পুরস্কার-দুটোই তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় পেয়েছেন। সমকালীন জাপানি সাহিত্যের তিনি এক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। ইয়ুকিউ মিশিমার পরবর্তী প্রজন্মের ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হিসেবে তাকেশি কাইকোকে গণ্য করা হয়। ষাটের দশকে সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি ভিয়েতনামে অবস্থান করছিলেন। সে সময় এশীয় ভূখণ্ডে মার্কিন আগ্রাসনের যে নগ্ন ছবি দেখেছিলেন তা তাঁকে মার্কিনবিরোধী অবস্থানের দিকে নিয়ে যায়। ভিয়েতনামের সেই অভিজ্ঞতার আলোকে অনবদ্য এক উপন্যাস রচনা করেন। উপন্যাসের নাম ওঘঞঙ অ ইখঅঈক ঝটঘ· এ উপন্যাস পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে বোদ্ধা পাঠকের ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। তাকেশি কাইকো মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৯ সালে। ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক ও টিভিব্যক্তিত্ব কাইকো ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে আইনশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। শুরুর জীবনে কিছুকাল আইনের পেশায় যোগ দিলেও এই পেশায় তিনি থাকেননি। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা। সাংবাদিকতা এবং সৃজনশীল সাহিত্য রচনাই ছিল মৃত্যুপর্যন্ত তাঁর প্রধান কাজ। পৃথিবীর ৪০টির মতো দেশ তিনি ভ্রমণ করেছেন। সেসব দেশের অধিকাংশই এশিয়া মহাদেশের। জাপানের বাইরে ওই সব দেশের পটভূমিতে তিনি রচনা করেন বেশ কিছু উপন্যাস। ফলে দেশগুলোর সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক।
জাপান ফাউন্ডেশন জাপানের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক প্রতিষ্ঠান। তাকেশি কাইকোর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে জাপান ফাউন্ডেশনকে বড় রকমের একটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকা থেকে বছরে একবার জাপান ফাউন্ডেশন আয়োজন করে ‘তাকেশি কাইকো মেমোরিয়াল এশিয়ান রাইটার্স লেকচার সিরিজ’। এশিয়ার কোনো এক দেশের একজন লেখককে আমন্ত্রণ জানায় জাপান ফাউন্ডেশন। সেই লেখক জাপানে গিয়ে তাঁর দেশের সাহিত্য এবং নিজের লেখা নিয়ে চারটা বক্তব্য দেন। বক্তব্যগুলো তিনি তাঁর নিজের ভাষায় লিখে জাপান ফাউন্ডেশনকে পাঠিয়ে দেন। ফাউন্ডেশন সেই বক্তব্য জাপানি ভাষায় অনুবাদ করে। লেখক তাঁর নিজের ভাষায় বক্তৃতা করেন, পাশে বসে একজন জাপানি ভাষার এক্সপার্ট সেই বক্তৃতার জাপানি অনুবাদ পাঠ করেন। ২০০৫ সালের জন্য বাংলাদেশকে নির্বাচন করে জাপান ফাউন্ডেশন। আর লেখক হিসেবে নির্বাচন করে আমাকে। ঢাকায় আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে এলেন প্রফেসর কিউকো নিওয়া এবং মিস্টার মাসাকি হিরানো। ২০০৫ সালের বক্তব্য দিতে আমি জাপানে গেলাম ২০০৬-এর মার্চে। প্রথম বক্তৃতা হলো হিরোশিমা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে। সেন্টারের পাশেই অ্যানা (অঘঅ) হোটেল। সেই হোটেলেই তোলা হলো আমাকে। ফাউন্ডেশন থেকে আমাকে একজন গাইড দিয়েছে। কচুর ডগার মতো নরম এক বাঙালি যুবক। নাম সুমন্ত ঘোষ। আরেক বাঙালি যুবক এবং শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করা প্রায় বাঙালি এক জাপানি ভদ্রমহিলাকে নিয়ে সুমন্ত আমাকে হিরোশিমা এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে এল। তারিখ ১০ মার্চ ২০০৬।
হিরোশিমায় নেমে আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। এই সেই হিরোশিমা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে, ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল আটটা ১৫ মিনিটে পৃথিবীর প্রথম আণবিক বোমা নিক্ষিপ্ত হয় এই শহরে। মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল শহরের অধিকাংশ দালানকোঠা, নিহত হয় এক লাখ ২০ হাজার লোক, পরে প্রাণ হারায় তার দ্বিগুণ।
অ্যানা হোটেলের খুব কাছে সেই জায়গা, যেখানে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল আণবিক বোমা। হেঁটে যেতে কয়েক মিনিট লাগে। হোটেলে লাগেজ রেখেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। এলাকাজুড়ে ‘পিস মেমোরিয়াল পার্ক’। ১৯৫৫ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়াম’। পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ এই মিউজিয়াম দেখতে আসে, আণবিক বোমার ভয়াবহতার কথা মনে করে হিরোশিমা ট্র্যাজেডির জন্য এখনো চোখের পানি ফেলে। শিশুরা পিস মনুমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকে। হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কে ঘুরতে ঘুরতে আমার মনে পড়েছিল আমার দেশের কথা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কথা। স্বজন হারানোর বেদনায় আমার বুক ভারী হয়েছিল।
পিস মেমোরিয়াল পার্কের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে চারতলা এক পুরোনো বাড়ির কঙ্কাল। সুমন্ত বলল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাড়িটা ছিল পাবলিক লাইব্রেরি। আণবিক বোমার আঘাতে পুরো এলাকা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর শুধু এই বাড়িটা এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। গা থেকে খসে পড়েছে আস্তরণ, দাঁড়িয়ে আছে শুধু কঙ্কাল। আমি সেই বাড়ির সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি।
পরদিন বক্তৃতা। প্রফেসর কিউকো নিওয়া এবং মিস্টার মাসাকি হিরানোর সঙ্গে টোকিও থেকে এসেছেন আনোয়ার জাহিদ। তিনি এনএইচকেতে কাজ করেন। আমার বক্তৃতার জাপানি অনুবাদ করেছেন। অসম্ভব সুন্দর কণ্ঠের অধিকারী। স্টেজে বসে আমি এক প্যারা করে বক্তৃব্য পাঠ করি, আনোয়ার জাহিদ সঙ্গে সঙ্গে সেই এক প্যারার জাপানি অনুবাদ পড়েন। মিলনায়তন ভর্তি জাপানি লেখক, প্রকাশক, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক এবং হিরোশিমার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী। বক্তৃতার আগে মাসাকি হিরানো আমার হাতে একগাদা টাকা ধরিয়ে দিয়েছেন। প্লেনের টিকিট আগেই আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। হোটেলের খরচ ইত্যাদি সবই বহন করছে জাপান ফাউন্ডেশন। এর বাইরে প্রতিদিনকার হাতখরচের টাকা দিচ্ছে, বক্তৃতার জন্য দিচ্ছে। প্রতিটি বক্তৃতার জন্য আমাকে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু চারটি বক্তৃতা আমি লিখিনি। লিখেছি একটি। যেহেতু বক্তৃতার জায়গা ভিন্ন ভিন্ন, শ্রোতা ভিন্ন ভিন্ন, সুতরাং একটি বক্তৃতাই আমি পাঠ করব। এদিক দিয়ে আমার কিছুটা লস হয়ে গেল। চারটি ভিন্ন বক্তৃতা লিখলে তিন গুণ বেশি টাকা পাওয়া যেত। আর জাপানে থাকা অবস্থায় মারাটারা গেলে আমার পরিবার পেত বিশাল অঙ্কের টাকা। জাপান ফাউন্ডেশন আমার ইন্স্যুরেন্স দিয়েছিল ৩০ মিলিয়ন ইয়েনের। আর চমৎকার একটা স্যুভেনির বের করেছিল আমাকে নিয়ে।
চার দিন ছিলাম হিরোশিমায়। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি আর আমার শুধু মনে পড়ছে এই শহরের সেই ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডির কথা। এখনো সেই ভয়াবহ ্নৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন কিছু মানুষ। আণবিক বোমার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সেসব মানুষকে বলা হয় ‘হিবাকুশা’। আণবিক বোমা হামলার সময় হিরোশিমা শহরের লোকসংখ্যা ছিল দুই লাখ ৫৫ হাজার। বোমাটির ওজন ছিল ৬০ কেজি। যে বিমানটি বোমা বহন করছিল তার নাম ‘এনোলা গে’। বোমাটির নাম ‘লিটল বয়’। বিমানের কমান্ডার কর্নেল পল টিবেটস। ১৯৪৫ সালের ৫ আগস্ট টিবেটস আনুষ্ঠানিকভাবে ৪৪-৮৬২৯২ নম্বরের বোমারু বিমানটির নামকরণ করেন ‘এনোলা গে’। ‘এনোলা গে’ ছিল তাঁর মায়ের নাম। টিবেটসের নানার একটি প্রিয় উপন্যাসের নায়িকার নাম ছিল ‘এনোলা গে’। উপন্যাসের নায়িকার নামে মেয়ের নাম রেখেছিলেন ভদ্রলোক। ভূপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার ফুট উঁচুতে ১৩ কিলোটন শক্তিতে বিস্কোরিত হয় ‘লিটল বয়’। হিরোশিমা শহরের কেন্দ্রস্থলে, যেখানে বিস্কোরিত হয় বোমা, সেই জায়গাটিকে বলা হয় ‘এ বোম্ব ডোম’। বোমা বিস্কোরণের পর ‘এনোলা গে’র কো-পাইলট রবার্ট লুই দেখতে পেলেন একটি বিশাল ছাতার মতো ভয়ঙ্কর ঘন মেঘে হিরোশিমা ঢাকা পড়ে গেছে। শহরটি ফুটছে, ঝলসে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি আপন মনে বলে উঠলেন, ‘হায় ঈশ্বর, আমরা এ কী করলাম!’
সাওরির সঙ্গে দেখা হলো ১৪ মার্চ ২০০৬। টোকিওর হানেদা এয়ারপোর্টে সে আমাকে রিসিভ করতে এসেছে। পুরো নাম সাওরি তাকাহাসি। বয়স ২৭ বছর। জাপান থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পড়তে এসেছিল। ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে থাকত। পড়াশোনা শেষ না করেই জাপানে ফিরে গিয়েছিল। চমৎকার বাংলা বলে, চমৎকার রবীন্দ্রসংগীত গায়। সামান্য আনন্দেই শিশুর মতো হাততালি দেয়। আমার বাকি তিনটি বক্তৃতা হবে টোকিও, ওসাকা ও সেন্দাইতে। হাতে সময় ১০ দিন। এই ১০ দিন ২৪ ঘণ্টা সাওরি আমার সঙ্গে। এই তিন জায়গায় সে আমার গাইড। সাওরি এনএইচকেতে কাজ করে। দেখা হওয়ার মুহূর্তেই সাওরির সঙ্গে আমার ভাব হয়ে গেল। হানেদা থেকে ট্রেনে করে টোকিওর সেই আনা হোটেলে যাচ্ছি। ফাঁকা কামরায় আমি আর সাওরি; সাওরি আমাকে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শোনাল-‘বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে লও’।
প্রথমবার টোকিওতে এসে আমি অনেক কিছুই দেখেছিলাম। যেমন ‘টোকিও টাওয়ার’ ‘রূপপুঙ্গি হিলস’। সাওরি আমাকে দেখাল ‘মুরি আর্ট মিউজিয়াম’ ‘মেইজি জিইনগু’ (মন্দির)। ১৫ মার্চ বেলা তিনটায় জাপান ফাউন্ডেশন ভবনের নিজস্ব অডিটরিয়ামে বক্তৃতা। মিলনায়তন ভর্তি দর্শক-শ্রোতার মধ্যে তিন-চারজন মাত্র বাঙালি। মনজু ভাই, প্লাসিড, এমদাদ। কিন্তু সেদিন জাপানি রীতিনীতি ভেঙে বক্তৃতা শুরু করতে হলো পাঁচ মিনিট দেরিতে। কী কারণ? মাসাকি হিরানো হাসিমুখে বললেন, ‘তোমাদের রাষ্ট্রদূত সাহেব আসবেন। তিনি অনুরোধ করেছেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছাবেন। তিনি এলে যেন বক্তৃতা শুরু হয়।’ আমি একটু বিরক্তই হলাম। এই সেই ভদ্রলোক, বৈশাখী মেলায় আমাকে পাত্তাই দেননি। ভদ্রতা করেও একটি কথা বলেননি। যা হোক, পাঁচ মিনিট পরে আমি মিলনায়তনে ঢুকলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার সম্মানে উঠে দাঁড়ালেন মিলনায়তন ভর্তি মানুষ। প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের রাষ্ট্রদূত। তাঁর পাশে পরবর্তীকালে বাংলাদেশে যিনি জাপানি রাষ্ট্রদূত সেই ভদ্রলোক। আমি দুজনকেই অভিবাদন জানালাম। বলতে লজ্জা লাগছে, তবু বলি, পরবর্তীকালে বাংলাদেশে জাপানি রাষ্ট্রদূত ভদ্রলোক আমার বক্তব্য শুনে এতটা মুগ্ধ হলেন, আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার সময় উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন, ‘আরে, তোমার তো··· প্রাইজ পাওয়া উচিত।’ সাওরি আমার পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছিল।
সাওরি আমাকে টোকিওর এক সাকুরা বাগানে নিয়ে গিয়েছিল। তিন-চার ঘণ্টা সেই ফুলের বনে আমরা ঘুরে বেড়ালাম। একদিন জাপানের ঐতিহ্যবাহী কাভুকি নাটক দেখাল। সেই রাতে বসন্তের হাওয়া বইছিল পুব দিক থেকে। সাওরি বলল, এই হাওয়াকে জাপানি ভাষায় বলে ‘সুমপু’।
টোকিও থেকে ওসাকা গিয়েছিলাম ‘সিনকেনসেন’-এ। মানে বুলেট ট্রেনে। সেই পথে দেখা হলো ‘ফুজি মাউনটেন’। জাপানিরা শ্রদ্ধা করে বলে ‘ফুজি সান’। তারিখ ১৭ মার্চ ২০০৬। আমার শেষ বক্তৃতা ছিল ‘সেনদাই’তে। সেনদাই লিটারারি মিউজিয়ামে। সেখানে ঢুকেই দেখি নূরজাহানসহ আমার অনেক বই সাজিয়ে রাখা। আর দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের বিশাল এক ছবি। আমাকে দেখে বেশ একটা সাড়া পড়ল দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে। একজনও বাঙালি নেই, সবাই জাপানি। আমার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ভালো রকম ব্যগ্র দেখলাম তাদের। সাওরি দূরে দাঁড়িয়ে শুধু মিটিমিটি হাসে। এই মেয়ে আমাকে ‘কিয়োটো’ নিয়ে গিয়েছিল। কিয়োটো জাপানের প্রাচীনতম এক শহর। মন্দিরের শহর। ওই শহরে দার্শনিকদের হাঁটার জন্য আলাদা একটা রাস্তা আছে, রুপার মন্দির আছে, সোনার মন্দির আছে। সাওরি আমাকে ঘুরে ঘুরে সব দেখাল। সেবার জাপানে সাওরির সঙ্গে ১০টি দিন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময়।
তৃতীয়বার
২০০৮ সালের আগস্টে আবার গিয়েছি জাপানে। সেবার শুধু টোকিওতেই। জাপানে প্রচুর বিক্রমপুরের লোক। বিক্রমপুর সোসাইটি খুবই নামকরা সংগঠন। তাদের অভিষেক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি আমাকে ‘রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হবে। সেই অ্যাওয়ার্ড নিতে গেছি। এমদাদ নামে আমার এক প্রিয়ভাজন অন্য একটি মেলার আয়োজন করেছে। সেই মেলায়ও আমি প্রধান অতিথি। প্রথমে এমদাদের অনুষ্ঠান। তার সঙ্গে থাকলাম চার দিন। তারপর বিক্রমপুর সোসাইটির অনুষ্ঠান। সোসাইটির সভাপতি নূর আলী আমাকে নিয়ে তুলল অন্য হোটেলে। ঢাকা থেকে কিছু নাচ-গানের শিল্পী, অভিনয়শিল্পীও এসেছেন এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে। দেলোয়ার নামে আমার অতিপ্রিয় একটি ছেলে সারাক্ষণ আমার সঙ্গে। সেবারের ভ্রমণে দিনগুলো কেটেছিল বিক্রমপুরের ছেলেদের সঙ্গেই, খুব আনন্দে।
আপাতত শেষবার
আবার সেই পি আর প্লাসিড। ২০০৯ সালের বৈশাখী মেলা উপলক্ষে প্লাসিড প্রথমবারের মতোই আমার একক বইয়ের স্টল করল। দ্বিতীয়বারের মতো ‘বিবেকবার্তা পুরস্কার’ দিল আমাকে। আমার হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন মিসেস ক্যাথরিন মারিনো। ‘ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাব অব জাপান’-এর প্রেসিডেন্ট তিনি। ইকেবুকোরো নিশিগুচি পার্কের যেখানটায় আমাদের শহীদ মিনার, তার প্রায় লাগোয়া একটি মিলনায়তনে এক মনোরম সন্ধ্যায় ক্যাথরিন আমার হাতে এই পুরস্কার তুলে দিলেন। তিনি আমেরিকান, স্বামী জাপানিজ। ভদ্রমহিলা যতটা জাঁদরেল, ভদ্রলোকটি ততটাই নম্র। স্ত্রীর প্রতিভায় খুবই মুগ্ধ ভদ্রলোক। দেশে ফিরে দেখি প্রতিটি ইংরেজি দৈনিকে ক্যাথরিন আমার হাতে পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন এই ছবি ছাপা হয়েছে।
জাপানে এক বক্তৃতায় দেশটিকে বলেছিলাম ‘আমার দ্বিতীয় দেশ’। বলার কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের বাইরে এই একটি মাত্র দেশ, চারবার গিয়েছি সেই দেশে, চারবারই সাহিত্যের জন্য কোনো না কোনোভাবে সম্মানিত হয়েছি আমি। তাকেশি কাইকো ্নারক বক্তৃতার মতো বিশাল সম্মান জুটেছে। সুতরাং জাপানের কাছে আমার ঋণ অনেক।
এবার সাওরির সঙ্গে দেখা হয়নি। সাওরির বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামীর সঙ্গে সে এখন ওসাকায়। ফোনে কথা হয়েছে। ফেরার সময় খুব মনে পড়ছিল তার কথা। কিয়োটোর সোনার মন্দিরে সে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গান-
আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।
أحدث أقدم