এতকাল আমি শান্তিতে ছিলুম।

  

রাসেল – ২

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

এতকাল আমি শান্তিতে ছিলুম।
ছোট্ট একটা ঘর আমার।
ছায়াময়, একটু গলির ভিতরের নির্জনে।
সারাদিন প্রায়ই কথা না বলে কাটানো যেত।
লোকে আমার নাম জানে না, খুব কম লোকেই আমাকে চেনে।
আমি নিজের কাছেই নিজের রাসেল ।
ভালোবাসার, আদরের রাসেল।
বাড়িওলার বৌ বলল- আপানার কাছে একজন এসেছিল।
-কে? অন্যমনস্ক আমি সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ঘাড় না ফিরিয়েই জিজ্ঞেস করলুম।
-সুন্দরমত একজন।
চমকে মুখ ঘুরিয়ে দেখি বাড়িওলার বৌয়ের মুখে একটু সবজান্তা হাঁসি।
ওর অনেক বয়স তবুও হাঁসিটা অনেক সুন্দর দেখাল- মায়ের মতো হাঁসি।
দুটো সিঁড়িতে দু'পা রেখে দাড়িয়ে রইলুম।
-খুব সুন্দর। বাড়িওলার বৌ বলল- কে?
বুঝতে পারছিলুম। তবু জিজ্ঞেস করতে ভয় করছিল- ছেলে না মেয়ে!
-ভাবসাব দেখে মনে হল আবার আসবে। বাড়িওলার বৌ বলল- আমার ঘরে বসিয়ে রেখেছিলুম অনেকক্ষণ।
চা করে খায়িয়ে দিয়েছি। কথাবার্তা বেশি হয়নি, ভয় নেই।
ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললুম না।
অন্ধকারকে ডেকে বললুম- ধরা পড়ে গেছ।
রাতে শুতে গিয়ে কষ্টটা টের পেলুম।
বুকে পেটে কিংবা কোথায় যে একটা বিশ্রী ব্যথা।।
ছোট্ট একটা মাছের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুম আসছিল না।
কেবল ভয় আর ভয়। কিছু একটা ঘটবে আমি টের পাচ্ছিলুম।
আমি এইরকম।
খুব বড় একটা বাড়িতে অনেক অপোগণ্ড ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমার ছেলে-বেলা কেটেছিল।
তারা সব আমার জেঠতুতো খুড়তুতো পিসতুতো ভাইবোন- অনাদরে রুক্ষ চেহারা তাদের,
ঝাকড়- মাকড় চুল, গায়ে তেলচিটে ময়লা, ঝগড়াটে, হিংসুটে।
প্রকান্ড ঘরের মেঝেয় ঢালাও এজমালি বিছানায় শুতে যাওয়ার সময় তাদের জায়গা নিয়ে ঝগড়া হত।
বাড়ি তাকে বড় বললুম।
কিন্তু হিসেবে ধরলে বাড়িটার এলাকাই ছিল বড়, বড় উঠোন ভিতরে, বাইরে বড় কচ্ছপের পিঠের মত ঢালু একটা মাঠ।
ভিতর বাড়িতে বড় উঠোন ঘিরে কয়েকখানা ঘর- যাদের নাম ছিল পুব পশ্চিম উত্তর বা দক্ষিণের ঘর।
এক উত্তরের ঘর ছাড়া আর কোনও ঘরের পাকা ভিত ছিল না।
আমাদের বাড়িটা যে লক্ষ্মীছাড়া ছিল, কিংবা আমাদের যে খুব অভাব ছিল তা নয়।
বরং উল্টোটাই আমাদের অনেক ছিল।
শুধু আশ্রিত আত্মীয়স্বজন আর যৌথ থাকার চেস্টাই যে ভিড় বেড়েছিল তাইতেই বাড়ির মধ্যে ছিল একটা দিশেহারা ভাব।
অনেক ছেলেমেয়ে ছিলুম আমরা, যাদের কেউ কেউ পরে অনেক বড় কিছু হয়েছে।
কিন্তু অতগুলোর মধ্যে কখন কোনটার হাত- পা কাটল, কোনটা পড়ে মরল,
কোনটা পুকুরে ডুবল এই চিন্তায় আমাদের বড়িতে একটা 'গেল গেল' ভাব সবসময় টের পাওয়া যেত।
আমার দাদুর কোনও ঢিলেমি ছিল না- তিনি সবসময় কৌটোর মুখ ভাল করে আটকাতেন, দরজার হুড়কো দিতেন ঠিক মত,
আর সন্ধেবেলা আমাদের গুনে গুনে ঘরে তুলতেন।
মা বাবার কাছে সোয়ার নিয়ম ছিল না, আমরা উত্তরের ঘরের মেঝেয় শুতুম একসঙ্গে,
দাদু থাকতেন চৌকিতে, বিড়বিড় করে বীজমন্ত্র বলতেন দাদু ঠাকুমার সঙ্গে, ছোটখাটো বচসা হত,
আর ঘুম ভেঙ্গে মাঝে মাঝে শুনতুম দাদুর গুড়ুক গুড়ুক তামাক খাওয়ার শব্দ।
আমাদের পরিবারে নাম রাখার একটা রীতি ছিল।
আমার আগের ভাইদের নাম রাখা হয়েছিল অনিমেষ, হৃষীকেশ, পরমেশ, অজিতেশ, সমরেশ ... ইত্যাদি।
সবমিলিয়ে প্রায় উনিশজনের ওরকম নাম রাখা হয়েছিল।
আমার বেলায় আর নাম পাওয়া যাচ্ছিল না।
শোনা যায় অনেক ভাবনা চিন্তার পর আমার বড়দা রায় দিয়েছিলেন- মাত্র দুটি নাম বাকি আছে।
সুটকেস আর সন্দেশ।
কোনটা পছন্দ বেছে নাও।
আমার ধর্মবিশ্বাসি মেজোকাকা আমার নাম দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ধর্মেশ।
সেটা বাতিল করে দাদু আমার নাম রাখলেন সুমনেশ।
ভাল মনের অধিকারী।
কেউ মুখে কিছু বলেনি কিন্তু অনেকেরই পছন্দ ছিলনা নামটা, আমার মায়েরও না।
তাই কালক্রমে শুধু রাসেল হয়ে উঠেছিলাম।
নবীনতর পূর্বতন