পাগলী মেয়েটা

Image result for valobashar picture
আকাশটা আজ সকাল থেকেই বড্ড বেঁকে বসেছে। 
একরকম পালা কীর্ত্তণের মতই কম বেশি বৃষ্টি হয়েই চলেছে। দুপুরই হবে বোধয়। এই মফস্মল শহরের প্লাটফর্মে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে।
বেশ শুনশান মতই। শুধু বৃষ্টির জলের অবিরত শব্দ ছাড়া আর শোনবার মত কিছু নেই এখানে।
কিন্তু ওয়েটিং শেডের কোনের দিকটার ঘটনাটি একটু অন্যরকম। 
দূর থেকে কেউ দেখলে বুঝতে পারবে না সেখানে কি ঘটে চলেছে। 
ওয়েটিং শেডের নীচেই একটা বছর ২৪ কি ২৫ এর ছেলেকে দেখা যায়। 
সে উন্মাদের মত দিশেহারা হয়ে কি যেন খুঁজে চলেছে। তন্য তন্য করে কিসের যেন সন্ধান করছে।
"হ্যালো....আপনি কি কিছু খুঁজছেন ওখানে?" প্রশ্নটি শুনে ছেলেটির হুঁশ ফেরে।
সে পেছনে ফিরে চাইতেই দেখল কলেজ স্টুডেন্ট টাইপের একটা মেয়ে অদূরেই দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে।
"বলছি আপনি কি কিছু খুঁজছেন? অনেকক্ষন থেকেই আপনাকে দেখছি..., কিছু হারিয়েছে কি আপনার?" মেয়েটি আবার বলল।
ছেলেটি ভগ্ন স্বরে একরাশ উত্তেজনা নিয়েই বলল,"আজ এখানে একটা সবুজ প্যাকেটে আমি আমার অ্যাডমিট কার্ড আর ইন্টারভিউ লেটার শুদ্ধু একটা ফাইল ভুল করে ফেলে গেছি। আমার সব শেষ হয়ে গেল..., কালই আমার ইন্টারভিউ...।"
ছেলেটি ভেঙে পড়ল হতাশায়, মাথা হেঁট করে বসে পড়ল নিচে। কতক্ষন যে এরকম বসেছিল সে জানেনা। 
সহসা মেয়েটির কন্ঠস্বরে তার স্নায়ুগুলি সজাগ হয়ে ওঠে, লাফিয়ে উঠে পড়ে সে।
"আবির গোস্বামী..., এল.এল.এম. ফ্রম ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি..., পাসড ডব্লিউ বি সি এস মেইন এক্সাম...।
"মেয়েটি মুখে চটুল হাসি নিয়ে একটি ফাইল খুলে পড়তে থাকে। 
এইতো তার ফাইল! সে এক ছুটে মেয়েটির কাছে চলে যায়। 
হারাধন পাওয়ার আনন্দে তার সর্বশরীর উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। চোখে জল চলে আসে তার।
মেয়েটি ফাইলের ডকুমেন্ট পড়া বন্ধ দিয়ে ছেলেটির দিকে তাকাল।
খিলখিল করে একরেশ হেসে নিয়ে বলল, "জানতাম, কোনো এক বেখেয়ালী পাগল এটার জন্য দিকবিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আসবেই, তাই পড়ে রইলাম এখানে।"
ছেলেটি তার অন্তরের সর্বশক্তি দিয়ে মেয়েটিকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালে মেয়েটি বলল "ব্যাস দ্বায়িত্ব সেরে ফেললেন? আমি এতক্ষন এখানে বসে রইলাম শুধু ধন্যবাদের জন্য বুঝি?
একঝাঁক উস্কো খুস্কো চুলের দোকান মাথায় নিয়ে ছেলেটি জিজ্ঞাসুভাবে চেয়ে রইল তার দিকে।
মেয়েটি চোখ টেরিয়ে বলল, "ট্রিট দিতে হবে। এই বৃষ্টিতে আপনার ধন্যবাদ নিয়ে করব'টা কি শুনি?"
ছেলেটি লজ্জিত হয়ে বলল, "কি ট্রিট চান বলুন প্লিজ...আমি দেব।"
"থাক এখন ট্রিট দিতে হবেনা। আগে এক্সাম পাশ করুন, জব পান তারপর নাহয় ট্রিট দেবেন!"
ছেলেটি কি যেন একটা তালগোলের মধ্যে পড়ল। 
খানিক ভেবেই উতকন্ঠিত হয়ে বলে, "বুঝলাম, কিন্তু আপনাকে পাব কোথায়?"
প্লাটফর্মে ট্রেন ঢুকে পড়েছে। 
মেয়েটি তড়িঘড়ি করে ছাতা মাথায় দিয়ে ট্রেনটির দিকে এগিয়ে যায়; তারপর পিছনে ফিরে চায়। খিলখিল করা হাসির ফোয়ারা তুলে ছেলেটিকে বলল, "আবার কিছু হারিয়ে ফেলবেন যখন, আমাকে পেয়ে যাবেন।"
ট্রেন ছেড়ে দেয়, ঘটনাটি কি যে ঘটে গেল ছেলেটি বুঝে উঠতে পারল না। একহাতে ফাইলটি নিয়ে উদাসীনভাবে চলন্ত ট্রেনটির দিকে চেয়ে থাকে।
কে এই মেয়েটা? 
নিশ্চই ভগবান তার দূত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তার মত পাগলকে উদ্ধার করতে।
ফাইলটা হাতে নাড়াচাড়া করতে গিয়েই হাত থেকে উল্টে পড়ে যায়। ছেলেটি যখন নিচু হয়ে ফাইলটি তুলতে গেল, যে জিনিসটা তার চোখে পড়ল সেটি তার কল্পনাতেও ছিল না!
একটু ভালো করে দেখলে দেখা যাবে, ফাইলের উল্টো দিকে মুক্তোর মত অক্ষরে একটা লেখা, " এরকম বেখেয়ালী আর হবেন না।তখন ট্রেন ছেড়ে দিয়ে আবার আপনার জন্য সারাবেলা প্লাটফর্মে অপেক্ষা করতে পারব না কিন্তু। ইন্টারভিউতে ফল ভাল হোক, শুভেচ্ছা রইল।"
লেখার শেষে দশটা ডিজিটের একটা নাম্বার দেখা গেল, হ্যাঁ মোবাইল নাম্বার।
ছেলেটি আশ্চর্য তো হলই কিন্তু এতক্ষন কি যেন একটা জিনিস তার কাছ থেকে হারিয়ে গেল এই চিন্তা তার চেতনায় ঘুরপাক খাচ্ছিল তাকে আবার ফিরে পেল।
দূর হতে দূরে চলে যাওয়া ট্রেনটির দিকে সে একবার চাইল। 
বাদলা হাওয়ার শীতলতায় একবার নিজেকে জুড়িয়ে নিল।মনের গভীর হতে ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি নিয়ে আনমনে বলে উঠল, "পাগলি মেয়েটা।"
নবীনতর পূর্বতন