বপ্নিল আমার ছোটবেলার বন্ধু। স্বপ্নিল নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। একসাথে পড়াশোনা শেষ করার পর ও একটি প্রাইভেট কলেজে লেকচারার হিসেবে আর আমি একটি ব্যাংকে চাকরি নিলাম। স্বপ্নিল প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল ভালো কোনো সরকারি চাকরি পাওয়ার কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না। স্বপ্নিল একদিন বিকেলবেলা আমার অফিসে হাজির। চুলগুলো এলোমেলো আর চেহারায় স্পষ্ট কষ্টের ছাপ। বসতে বলে জিজ্ঞেস করলাম,”কি হয়েছে তোর”? কিছুক্ষণ পরে বললো, “আগামী শুক্রবার রুপার বিয়ে।আর বিয়েটা হচ্ছে সম্পূর্ণ রুপার ইচ্ছানুযায়ী”। কথাটা শুনে বেশ অবাক হলাম।
রুপা আমাদের এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে সেই রুপাই ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় ওর এক বান্ধবীর মাধ্যমে স্বপ্নিলকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। আমরা দুজনেই বেশ অবাক হয়েছিলাম। কারন বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে রুপা। পরে রুপার লেখা চিঠি পড়ে বিশ্বাস করলাম। স্বপ্নিলের সাথে রুপার টানা সম্পর্ক চলল। স্বপ্নিল লেকচারার হিসেবে যোগ দেয়ার পর আমিই রুপার বাসায় ওদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম। সব শুনে রুপার মা বললেন, “মেয়ের যখন ওকে পছন্দ তখন আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বিয়ের পর ছেলেকে আমাদের বাসায় থাকতে হবে। কারন, আমার মেয়ে কিছুতেই ঐ ঘুপচি ঘরে গিয়ে থাকতে পারবেনা।”
একথা শুনে স্বপ্নিল তো মহাক্ষ্যাপা। বললো, “আমি কিছুতেই ঘরজামাই হতে পারবোনা। আমার বাবা-মা আমাকে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছে, তাদের ছেড়ে অন্যের আশ্রয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।” রুপাও নাছোড়বান্দা, স্বপ্নিলকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবেনা। স্বপ্নিলের ভালো একটা সরকারি চাকরির প্রতীক্ষায় রইল সে। পরপর দুটি বিসিএস পরীক্ষায় ভালো করেও ভাইভা থেকে বাদ পড়লো স্বপ্নিল। এবার আর রুপা কিছুতেই সুযোগ দিতে রাজি নয়, সহ্যের বাধ ভেংে গেছে তার। একদিন সকালে স্বপ্নিলকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে বললো, “তোমাকে দিয়ে ভালো কিছু আশা করা যায়না। একেতো আমাদের বাসায় থাকতে রাজি হচ্ছনা আর ভালো কোনো চাকরিও পেলেনা। তোমার সাথে আমার ঘর বাধার স্বপ্ন ভেংে গেছে। বাবার পছন্দ করা ছেলেকে আগামী শুক্রবার বিয়ে করতে যাচ্ছি। দয়া করে বাধা দেবেনা, আমাকে ভুলে যেও।” এসব কথা যখন স্বপ্নিল আমাকে বলছিল কষ্টে তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝরছিল।
প্রস্তাব দিলাম, “চল কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি।সমুদ্রের কাছে সব দু:খ বিসর্জন দিয়ে আসবো”। কক্সবাজার যাওয়ার আগে আরেকবার রুপাদের বাসায় গিয়ে শেষ চেষ্টা করলাম বিয়েটা ভাংার কিন্তু লাভ হলো না। এরপর কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মাঝামাঝি এলাকা লোহাগড়ায় এসে বিশ মিনিটের চা বিরতি দিল। আমরা গাড়ি থেকে নেমে একটা হোটেলে গিয়ে নাস্তা খেতে শুরু করেছি সেই সময় একটি সুন্দরী মেয়ে আমাদের দিকে দৌড়ে এসেই স্বপ্নিলের শার্ট দুহাত দিয়ে খামচে ধরে বললো, “তুমি এখানে নাস্তা খাচ্ছো, আর আমি তোমাকে সারা পৃথিবী জুড়ে খুজে বেড়াচ্ছি। নিলয় প্লীজ তুমি আমাকে আর কষ্ট দিও না, তোমাকে হারানোর ব্যথা আর সহ্য করতে পারবোনা।” এরকম ঘটনায় আমরা দুজনেই হতবাক। পরে ভাবলাম মেয়েটি নিলয় নামে যাকে খুজছিল সে হয়ত স্বপ্নিলের মতো দেখতে।
এরইমধ্যে মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা এসে জোর করে মেয়েটিকে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। মেয়েটিকে একটি পাজেরো গাড়িতে রেখে ভদ্রলোক আবার আমাদের কাছে এলেন।এসে বললেন, “তোমরা কিছু মনে কোরোনা। ও আমার একমাত্র মেয়ে নীলা। আমরা স্বপরিবারে অস্ট্রেলিয়া থাকি। দুইমাস আগে আমার বন্ধুর ছেলের সাথে এনগেইজমেন্ট হয়েছে। ওদের দুজনার আগে থেকেই সম্পর্ক ছিল। গায়ে হলুদের আগেরদিন দুজনে শপিং করে ফেরার সময় একটা মারাত্মক এক্সিডেন্ট হয়। এক্সিডেন্টে নিলয় ঘটনাস্থলেই মারা যায় আর নীলা প্রায় অক্ষত অবস্থায় বেচে যায়। হসপিটালে কিছুদিন থাকার পর ডাক্তার বললেন নীলাকে কিছুতেই জানানো যাবেনা নিলয়ের মৃত্যুর সংবাদ। কারন, নীলা মানসিকভাবে সুস্থ নয়, জানালে মানসিকভাবে আরো আঘাত পাবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওকে কক্সবাজারে বেড়াতে নিয়ে এলাম ওর সুস্থতার জন্য। কিন্তু একটা বিষয়ে অবাক হলাম ওর সাথে(স্বপ্নিলের দিকে ইশারা করে) নিলয়ের চেহারার অনেক মিল আছে।”
ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা বের করে দেখালেন। ছবিটা দেখে আমরা দুজনেই অবাক। এযেন স্বপ্নিলের যমজ ভাই। শুধু পার্থক্য একটাই স্বপ্নিল ফর্সা আর ছবির ছেলেটা একটু শ্যামলা। ভদ্রলোক একটা চেয়ার টেনে আমাদের পাশে বসে আরো নাস্তার অর্ডার দিলেন। নাস্তা করার ফাঁকেফাঁকে স্বপ্নিলের ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নিলেন। ইতিমধ্যে আমাদের গাড়ির গাইড জানিয়ে গেল গাড়ি এখনই ছাড়বে। আমরা যখন ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠতে গেলাম তখন খেয়াল করলাম সেই মেয়েটা এক দৃষ্টিতে স্বপ্নিলের দিকে তাকিয়ে আছে।
আজ রুপার বিয়ে। একদিকে রুপাদের বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে। অন্যদিকে, স্বপ্নিলের শরীরে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে যেন ওর হৃদয়ের সব কষ্টকে ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে সমুদ্রে ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম নীলা মেয়েটি তীরে দাড়িয়ে চিৎকার করছে নিলয়, নিলয় বলে। স্বপ্নিল বললো, “সেই মেয়েটা এখানেও, কি করি বলতো? ” হেসে বললাম, “কেন তুই স্বপ্নিল থেকে নিলয় হয়ে যা। তাছাড়া, মেয়েটা রুপার চেয়ে অনেক সুন্দরী।” তীরে ওঠার পর মেয়েটার বাবার সাথে আবারো দেখা হয়ে গেল। ওনার অনুরোধে বাধ্য হয়েই আমাদের হোটেল ছেড়ে তার ভাড়া করা বিশাল বাংলোতে উঠলাম। দুপুরবেলা খাওয়ার পর ভদ্রলোক আমাদের রুমে এসে হাজির। ভদ্রলোক আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে বললেন “তোমাদের সাথে দেখা হবার পর থেকেই নীলার মধ্যে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। ওর ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি। তিনি যা বললেন তাতে স্বপ্নিলই পারে আমার মেয়েকে সুস্থ করতে। একথা বলে তিনি কেঁদে ফেললেন।” স্বপ্নিলের হাত ধরে বললেন, “তোমাকে শুধু আমার মেয়ের সামনে নিলয়ের মতো অভিনয় করতে হবে।”
আমার এবং নীলার বাবার অনুরোধে স্বপ্নিল শেষ পর্যন্ত রাজি হয়। বিকেলবেলা স্বপ্নিল আর নীলা দুজনে একসাথে বের হলো ঘুরতে। ফেরার পর দুজনের মুখেই দেখলাম মিষ্টি হাসি। রুমে এসে স্বপ্নিল বললো, “মেয়েটা খুবই ভালো। বিদেশে এত বছর থাকলেও দেশের প্রতি ভীষন টান। আমাকে নিলয় মনে করে বলেছে দুজনের বিয়ে হয়ে গেলে ও আর অস্ট্রেলিয়া যাবে না। কোনো গ্রামে বাড়ি করে থাকবে। বাড়ির সামনে শান বাধানো পুকুর থাকবে। দুজনে মিলে পূর্ণিমা রাতে পুকুর পাড়ে বসে জ্যোৎস্না দেখবে।” স্বপ্নিলের নাকটা ঝাঁকিয়ে বললাম, “কিরে তুই কি নীলার প্রেমে পড়েছিস?” দুজনেই একসাথে হেসে উঠলাম। অনেকদিন পরে স্বপ্নিলের মুখে এমন প্রাণখোলা হাসি দেখে খুবই ভালো লাগল।
কক্সবাজার থেকে নীলাদের সাথেই একত্রে ঢাকায় ফিরলাম। এর কিছুদিন পরেই নীলার বাবা আমাকে নিয়ে স্বপ্নিলের বাসায় গিয়ে স্বপ্নিলের বাবা-মার কাছে নীলার সাথে স্বপ্নিলের বিয়ের প্রস্তাব দেন। সব শুনে ওনারা অমত করেনি। ধুমধাম করে ওদের বিয়েটা হয়ে যায়। বিয়ের দিন স্বপ্নিলকে বললাম, “অনেক ভালো কিছু পেতে হলে প্রথমে সামান্য কষ্ট পেতে হয়। রুমার মতো মেয়ে চলে গিয়েছিল বলেই নীলার মতো এতো ভালো মেয়েকে জীবনসাথী হিসেবে পেলি।”
বিয়ের পর নীলা আর অস্ট্রেলিয়া ফিরে যায়নি। ও এখন পুরোপুরিভাবে সুস্থ। অন্যদিকে, স্বপ্নিল এখন বড় সরকারি চাকরিজীবী। ভালোবাসায় পরিপূর্ণ ওদের সংসার। *”If someone hurt you, there is also someone to relieve your pain.”*