আন্টির বাসা থেকে বের হয়ে ছাতা ফুটিয়ে মাথায় দিতেই ফারিহা দেখল – ছেলেটা ভিজছে ।
বর্ষাকাল ।
যখন তখন ঝুম বৃষ্টি নেমে যায় । গবেট-শ্রেণির লোক দেখেও শেখে না – ঠেকেও শেখে না । ছাতা ছাড়াই বের হয় । এবং ভেজে ।
এই ছেলেটাকে তার গবেট শ্রেণির মনে হচ্ছে না ।
রাস্তার পাশে ফারিহা একটু দাঁড়াল ।
ঢাকার রাস্তায় বৃষ্টির দিনে রিকশা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার । রিকশাওয়ালারাও এই সুযোগে ভাড়া চারগুণের নিচে হাঁকে না ।
ফুটপাতের কিনারায় কাকভেজা ছেলেটার দিকে চোখ পড়তে বাধ্য । পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে স্বচ্ছল ঘরের সন্তান । হাতে একটি ফাইল । ইউনিভার্সিটির ছাত্র হবে হয়ত । চেহারা আকর্ষনীয় ।
হঠাৎ বৃষ্টিতে বিভ্রান্ত মানুষগুলোর মত এ আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে না ।
মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
ফারিহার ইচ্ছে করল ওকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয় ! রাস্তায় একটা রিকশা নেই – আর এদিকে ন্যাকামো হচ্ছে !
এমনিতেই ওর মনটা বিক্ষিপ্ত । আন্টির সাথে দেখা করার পর মেজাজ আরও চড়ে আছে ।
খালুর মামাতো ভাইয়ের ছেলে আমেরিকা থেকে বহুদিন পর বাংলাদেশে ফিরে এসেছে । আপদটা এসে জুটেছে আন্টির বাসাতেই । আর আন্টিরই যেমন কান্ডজ্ঞান – মাথায় উনার ঘটকালি ঢুকেছে । ফারিহার গুণের সাতকাহন তিনি সেই ছেলের সামনেই গেয়ে গেলেন । অপমানে পুরোটা সময় ফারিহার কান ঝাঁ ঝাঁ করেছে । তার ওপর বেরিয়েই এতসব ন্যাকামি দেখে রাগে ও দাঁতে দাঁত পিষল ।
‘আপা, কই যাবেন?’ সম্বিত ফিরে পেল ও রিকশাওয়ালার ডাকে ।
রিকশাওয়ালার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে । মেয়ে প্যাসেঞ্জার সাধারণতঃ বৃষ্টির দিন ভাড়া নিয়ে গ্যাঞ্জাম করে না ।
আড়চোখে ফারিহা দেখতে পেল – ছেলেটা হাঁটতে শুরু করেছে ।
রিকশাওয়ালাকে কোন জবাব না দিয়ে ফুটপাথ ধরল ও । ন্যাকাটার রহস্য ভেদ করতে হবে ।
তবে এ সিদ্ধান্ত জটিলতা বাড়াল বই কমালো না ।
ওভারব্রীজের নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় সিঁড়িতে বসে থাকা বৃদ্ধা মহিলাটির হাতে নিজের মানিব্যাগটা ধরিয়ে দেয় ছেলেটা ।
বিকারগ্রস্থের মত হেঁটে চলে সামনে ।
হাতে ধরা ফাইলটি ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তার পাশের ড্রেইনে ।
আবারও রাগে দাঁত কিড়মিড় করে ফারিহা । ঢাকার সুয়্যারেজ লাইনের এমনিতেই যে অবস্থা !
এর মাঝে আবার ফাইল ফেলা হচ্ছে । টাকা আছে – মানিব্যাগ দান করে দিচ্ছ বলে শহর তোমার বাবার ?
আর সহ্য হল না ওর । লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে ছেলেটাকে ধরে ফেলে ফারিহা ।
‘এক্সকিউজ মি?’
অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় ছেলেটা, ‘আমাকে বলছেন?’
‘না! আমি বৃষ্টিকণার সাথে কথা বলছি !’ ঝাঁঝের সাথে বলে ফারিহা, ‘ড্রেইনের মধ্যে ফাইলটি ছুঁড়ে ফেললেন – মানে ?’
ছেলেটার চোখ জ্বলে ওঠে, ‘যতদূর মনে পড়ে – আপনার কিছু ছুঁড়ে ফেলিনি ।’
‘শহরটা আপনার বাবার সম্পত্তি? ড্রেইনে আজেবাজে জিনিস ছুঁড়ে ফেলবেন – আবার যুক্তি দেখাচ্ছেন?’
‘আমার ইচ্ছা । তোমার ভালো না লাগলে তুমি মুড়ি খাও ।’ আবার সামনে হাঁটে ছেলেটা ।
ফারিহা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে । এরকম ভাষায় প্রথম সাক্ষাতেই কোন ছেলে তাকে এভাবে বলবে এ তার কল্পনাতেও ছিল না ।
প্রায় এক মাস পরের কথা ।
লাইনে দাঁড়িয়ে ফারিহা । ফার্মগেট যেতে নিউ ভিশন ধরতে চায় ও । পার্টটাইম জবের ব্যাপার আছে ।
লোকাল একটা ম্যাগাজিনের প্রুফ রিডিং করার কাজটা পড়ে আছে । ভার্সিটির সিনিয়র ভাই তূর্য চেয়েছিল কাজটা ওকে দিতে । তূর্য ভাইয়ের সাথে দেখা করতেই যাচ্ছে এখন ।
পর পর দুটো বাস চলে যাওয়ার পর মোটামুটি লাইনের সামনে চলে আসতে পারে ও ।
পরের বাসে উঠে প্রথম যে সীটটি ফাঁকা পায় বসে পরে ।
বাস আসাদগেট পৌঁছতেই ওর মনে হয় পাশের সারিতে বসা ছেলেটা ওকে দেখছে ।
ফারিহার চেহারা যথেষ্ট সুন্দর – এবং সে বিষয়ে ও নিজেও ওয়াকিবহাল, তবে না তাকিয়েও ছেলেটির দৃষ্টিতে কৌতুহল অনুভব করে ও ।
এক ঝলক দেখেই ও চিনতে পারে – বৃষ্টিতে ভেজা রহস্যময় ছেলেটিকে ।
হঠাৎ মেজাজ টং হয়ে যায় ওর আবারও ।
‘সেদিন বাজে কথা বলার সময় খেয়াল ছিল না ! এখন তাকাও কেন বেয়াদব ছেলে।’ মনে মনে ভাবে ফারিহা।
দ্বিতীয় সাক্ষাতের কোন ইচ্ছেই ওর মধ্যে নেই । বাস থেকে লাফিয়ে নেমে সামনে হাঁটে ও ।
এবং যা ভাবছিল – পেছন থেকে শুনতে পায়, ‘এক্সকিউজ মি’
ঘুরে যতটা সম্ভব সেদিনের উচ্চারণ নকল করে ফারিহা, ‘আমাকে বলছেন?’
‘দেখুন, গতবারের ব্যাবহারের জন্য আমি খুবই লজ্জিত । বিশেষ একটা কারণে সেদিন আমার মন এবং মেজাজ – কোনটাই নিয়ন্ত্রণে ছিল না ।’
ছেলে লাইনে এসেছে – নিজে থেকে ক্ষমা চাইছে – তার ওপর মায়াকাড়া একটা চেহারা – ঝগড়াঝাটির এখানেই ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল ফারিহা ।
‘সত্যি বলতে কি – সেদিন আমারও মন ভালো ছিল না । স্বীকার করতেই হচ্ছে – বাড়াবাড়ি আমিও কিছুটা করে ফেলেছি ...’
‘আমি তন্ময় ।’ হাত বাড়িয়ে দেয় ছেলেটা ।
‘ফারিহা ।’ হাত মেলায় ফারিহা ।
*
এক মাস কেটে গেছে আরও ।
তন্ময় আর ফারিহার নাম না জানা দশা পালটে গেছে গভীর বন্ধুত্বে ।
ফার্মগেটেই নম্বর আদান-প্রদান করেছিল ওরা । আসলে ফারিহারই উৎসাহ বেশি ছিল ।
তন্ময়ের সেদিনের ব্যাবহারের তাৎপর্য জানার জন্যই কি না – তা সে নিজেও জানে না ।
ধীরে ধীরে তন্ময়কে আরও ভালো করে চেনে ফারিহা – যে তন্ময়ের সাথে প্রথমদিনের সেই তন্ময়ের কোন মিলই নেই ।
‘১৫ই মার্চ – আমি ভুলিনি’ মনে মনে ভাবে ফারিহা । ‘কয়দিন লুকাবা তুমি । ঠিকই জেনে নিব, হুহ’
অবাক করা ব্যাপার হল – ওর কাছে জানতে চায় নি – এমনটা নয় । কিন্তু প্রতিবারই এড়িয়ে গেছে তন্ময় ।
এই যেমন আজ – জিয়া উদ্যানে হেঁটে বেড়াচ্ছে ওরা । কোন দিন কাজের অতিরিক্ত চাপ পড়লে একসাথে কোথাও ঘুরতে বের হয় মাঝে মাঝে । ফারিহার জীবনে বন্ধুদের সংখ্যা খুবই কম ছিল । তার মাঝেও তন্ময়ের মত খোলা মনের কেউ নেই । তন্ময়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমন – ফারিহার সাথে শেয়ার করে স্বস্তি পায় ও। দুইজনই একে অপরের মোবাইল নম্বর সেইভ করে রেখেছে BFF [বেস্ট ফ্রেন্ডস ফরেভার] নামে ।
হঠাৎ ফারিহাই তোলে প্রসঙ্গটা । আবারও ।
‘তুই – আজ পর্যন্ত একটাবারও আমাকে বললি না – আমাদের প্রথম পরিচয়ের দিন তোর কি হয়েছিল । ’
‘তোকে আমি আগেও কয়েকবার বলেছি – আমাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করবি না । আমি উত্তর দিতে পারব না । ’
‘ওকে !’ হাসে ফারিহা, ‘লেট মি গেস – তুই ছ্যাঁকা খেয়েছিলি ।’
‘একরকম ।’ অন্যদিকে তাকায় তন্ময় ।
‘মেয়েটা নিশ্চয় অনেক বোকা । নাহলে তোর মত ছেলেকে ছেড়ে যাবে কেন ?’
‘আমাকে খুঁচিয়ে তথ্য বের করতে চাইছিস তো ?’ চোখ পাকালো তন্ময়, ‘ফাইজলামি বন্ধ ! চল বাসায় ব্যাক করি । আমার ভালো লাগছে না ।’
মাঝে মাঝে ভাবে ফারিহা বোকাটার কথা । মানুষ মনে হয় আর প্রেম করে ছ্যাঁকা খায় না ?
এত রাখাঢাকির কি আছে ?
তবে একটা কথা ঠিক । তন্ময়ের কোনকিছুতেই পরাজয় পছন্দ না ।
ছেলেটা খুব ভালো ছবি আঁকতে পারে । প্রথম প্রথম কিভাবে ‘উন্মাদ’ নামক ম্যাগাজিনটি ওর কার্টুনকে রিফিউজ করে দিয়েছিল আর তা ওর জন্য কত বড় একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছিল সেই গল্প ফারিহার জানা ।
হয়ত এ কারণেই ওর পরাজয়ের কথা ও লুকিয়ে রাখতে চায় নিজের কাছেই ।
ফারিহাকে বললে কি হত ? সবই বলে ওকে তন্ময় ।
‘গাধা একটা’ – ভাবে ও ।
তার ওপর একদিন তূর্য ওর কাছে জানতে চায়, ‘কিরে, তন্ময়ের সাথে জুটলি কিভাবে?’
অবাক হয় ফারিহা, ‘আপনি ওকে চেনেন কিভাবে? লং স্টোরি ভাইয়া ।’
তূর্য অবাক হয়, ‘চিনব না ! আমার কলেজের ছাত্র ছিল । আমার এলাকায় থাকে । আমার ক্লোজ ছোটভাই । আমাদের ম্যাগাজিনে ও আর্ট নিয়ে মাঝে মাঝে সাহায্যও করে ।’
প্রশ্নটা করা ঠিক হবে কি হবে না – না বুঝেই করে ফেলে ও, ‘ভাইয়া ওকে কিছু একটা নিয়ে ডিস্টার্বড দেখি । ওর কি ইদানিং এর ভেতর ব্রেক আপ হয়েছে কারো সাথে? ’
ঘরের ছাদ কাঁপিয়ে হাসে তূর্য, ‘তন্ময় করবে প্রেম ? ব্রেক আপ তো পরের কথা । আমার জানামতে ওর কোন বান্ধবীও ছিল না । তাই তো তোর কথা ওর মুখে শুনে অবাক হলাম । আরে শিল্পী মানুষের মাঝে মাঝে উদাস হতে হয় । ও নিয়ে ভাবিস না ।’
লজ্জা পেয়ে সরে আসে ফারিহা । তূর্য ভাই নিশ্চয় ভেবেছে তন্ময়ের প্রেমে ও হাবুডুবু ! আর ও-ও একটা যাচ্ছেতাই ! এভাবে কেউ জানতে চায় ? কিন্তু – নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে যায় ফারিহা । তন্ময়কে কি ও বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু করে পেতে চায় না ?
তবে নিজেকে চোখ রাঙ্গায় ফারিহা । কেন ও এত করে ভাববে তন্ময়ের কথা ।
ওরা শুধুই বন্ধু । এভাবে ভাবাটা অন্যায় । কিন্তু ভাবাভাবির ব্যাপারটা কি আর ওর হাতে তখন আছে ?
পরের কয়েকটা দিন যতবার তন্ময়ের সাথে দেখা হয় ফারিহার – প্রতিবারই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় ওর । তন্ময়টাকে ছাড়তেই ইচ্ছে করে না । কোন কারণ ছাড়াই ওকে ফোন দিয়ে ডাক দেয় ও, ‘হ্যালো তন্ময় – মন ভালো না । চল কোথাও ঘুরে আসি ।’
আসলে ছাই – তন্ময়কে দেখার ছুতো । আর পাগলটাও যা – ইদানিং সারাদিনই ছবি আঁকে । যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ছবি নিয়েই বকবক করে । ওর আবার ইদানিং বিশ্বকে চমকে দেওয়া একটা ছবি আঁকার ইচ্ছে হয়েছে । ফারিহার কি আর অতসব মাথায় ঢোকে ? ও শুধু তন্ময়কে দেখে । ছেলেটার চোখ দুইটা এত্ত পরিষ্কার – ফারিহার ইচ্ছে করে ওখানে ডুবে মরতে । আর ও হাসলে তো ফারিহার মাথা হ্যাং করে যায় – এত সুন্দর করে একটা মানুষ হাসে কি করে ?
প্রায় প্রতিদিনই দেখা করলেও ফারিহার সাহস হয় না ওর অনুভূতির কথা বলার ।
না – তন্ময় 'না' করে দেবে সেই ভয়ে যতটা – তার থেকেও বড় ভয় তন্ময়ের প্রথম দিনের ব্যাখ্যার ।
ও যে পাগল – হয়ত সেই মেয়েকে জেতার একটা জেদ নিয়ে বসে আছে আজও ।
মাঝখান থেকে ফ্রেন্ডশীপে একটা দূরত্ব আসবে ।
প্রতিদিন তন্ময়কে কিভাবে দেখবে ও তখন ?
আরেকটি মাস প্রায় গড়িয়ে যায় এভাবে । এর মাঝে একদিন বহুদিন পর তন্ময়ের মুখে হাসি দেখে ফারিহা ।
‘তোকে বলেছিলাম আমার একটা – মাত্র একটা ছবি আঁকার সখ ছিল । পৃথিবীকে চমকে দেওয়ার জন্য ।’
‘তুই একটা পাগল । সব কিছুতেই তোর তাড়াহুড়ো ।’ ওকে আলতো ঘুষি মারে ফারিহা ।
‘ছবিটার কাজ শেষ,ফারিহা । আজ আমরা সেলিব্রেট করব ।’ ঘুষি ফেরত দেয় তন্ময় ।
‘কি খারাপ ! কি খারাপ !! আমাকে দেখাবি না ?’ অনুযোগ করে ফারিহা ।
‘অফকোর্স ! আর মাত্র কয়েকটা দিন দোস্ত ।’
কিন্তু কয়েকটা দিনের কথা বললেও আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ছবিটা দেখা হল না ফারিহার ।
বলা যায় – একটা সপ্তাহ তন্ময়ের সাথে ভালোমত যোগাযোগও হল না ফারিহার ।
মনে মনে গালি দিয়ে ওর ভূত ভাগায় ফারিহা – পাগলটার হয়ত ছবির কাজ বাকি ছিল – এখন আমাকে দেখাতে হবে তাই ডুব মেরে কাজ শেষ করছে – নিজেকে বোঝায় ও ।
মোবাইলের রিংটোন বাজতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ও – কিন্তু তন্ময় না – তূর্য ভাইয়ার কল । বিরক্ত হয়েই ফোন রিসিভ করে ফারিহা ।
‘তোকে কিভাবে ব্যাপারটা বলব বুঝতে পারছি না ।’
‘ভাইয়া কি তন্ময়ের শেষ ছবিটার কথা বলছেন ? অবাক হয়েছেন তো ? আমি জানতাম ও এবার অসাধারণ কিছু একটার জন্ম দেবে । আমি অবশ্য এখনও দেখি নি -’
‘তন্ময় মারা গেছে ফারিহা । গত পরশু রাতে ।’ কন্ঠ সিক্ত হয়ে আসে তূর্যের । ‘তার আগে আমাকে মেসেজ দিয়েছিল যেন তোকে বলি তোর মেইল চেক করতে । আমি ভেবেছিলাম তোদের ঝগড়া – তাই । তখন যদি বুঝতাম রে ...’
আরও কি কি বলে যায় অপরাধী কন্ঠ নিয়ে তূর্য ভাই – কানে কিচ্ছু শুনতে পায় না ফারিহা । হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে যায় আলতো করে ।
একটা যন্ত্রের মতই কম্পিউটারের সামনে বসে পড়ে ও ।
ফেসবুক এবং মোবাইল চেক করলেও ই-মেইলটা রোজ চেক করা হয় না ।
একটি অ্যাটাচমেন্ট সহ একটী মাত্র আনরীড মেইল ।
প্রথমে ওর চোখ পড়ে ছবিটির ওপর ।
ফারিহার একটা পোট্রেট । সম্পূর্ণ ডিটেইলস তন্ময় নিজের মাথা থেকে এঁকেছে । ফারিহার মুখে একটা অপার্থিব হাসি – যে হাসিতে একই সাথে ভালোবাসা – কান্না – সুখ এবং দুঃখের প্রতিচ্ছবি । একটি সাধারণ ছবি কিভাবে অসাধারণ হয়ে ওঠে চোখের সামনে তা ফারিহা বুঝতে পারল না – তখন ওর চোখ বার বার ঝাপসা হয়ে আসছে ।
মেইলটা ওপেন করল ও ঝাপসা চোখেই ।
‘ফারিহা,
তুই অনেক ভালো একটা মেয়ে । এবং অসাধারণ । পৃথিবীতে যদি এখনও একটা নিখুঁত মেয়ে থাকে – তবে নিঃসন্দেহে সেটা তুই ।
আমি চিঠি লেখতে পারি না – লেখিনি কখনও । কিন্তু তোর কিছু কথা জানার অধিকার আছে – যে কথাগুলো আমি সামনে দাঁড়িয়ে তোকে কখনোই বলতে পারব না ।
তুই সবসময় বলতি আমি বোকা । তোর কথা এতটা সত্য আমি নিজেও জানতাম না । তোর বন্ধুত্বের আড়ালে নিজেকে অনেক সুখী মনে হত – জীবনকে অনেক শান্ত । কখন যে বোকার মত তোর প্রেমে পড়ে গেলাম !
তুই আমাকে ভালোবাসতি সেটা আমি জানি – তুই আমাকে ফিরিয়ে দিতি না – সেটাও আমি জানি ।
এখন হয়ত ভাবছিস – কেন তোকে বলিনি? আর কেনই বা তোকে আমার জীবনের সবকিছু শেয়ার করেছি শুধু আমাদের প্রথম দেখার দিনটি বাদ দিয়ে ?
তারিখটি তোর মনে আছে কি না জানি না । তবে আমার আছে ।
১৫ই মার্চ । যেদিন আমি হাতে পেলাম আমার ক্যাট স্ক্যানের রিপোর্ট ।
মাথা আরও কয়েক মাস ধরেই হঠাৎ হঠাৎ প্রচন্ড রকম ব্যাথা করত । পাত্তা দেইনি । অনেক সময় নিয়ে ছবি আঁকতাম বলে ভাবতাম – চোখের ওপর বেশি প্রেশার দেওয়ার ফল । অবশেষে ডাক্তার দেখালাম । স্ক্যান করতে বলল আমাকে । স্ক্যান রিপোর্ট নিয়ে কন্সাল্টেশন সেন্টার থেকে মাত্র দুঃসংবাদটা নিয়ে বের হয়েছি – বড়জোর দুই থেকে আড়াই মাস বাঁচব আমি - ঠিক তখনই দেখিস তুই আমাকে ।
টিউমারটা এতটাই গ্রো করেছিল আমার দশমিকের কোঠায়ও সুযোগ ছিল না ।
আমাকে মাফ করে দিস ফারিহা । তোকে পেয়ে হারানোর বেদনা দিতে চাইনি ।
আর – বেশি কাঁদিস না ।
কথা দিচ্ছি – এই জন্মে হতে না পারলেও ওই জন্মে ঠিকই তোর হব ।
- ফারিহার তন্ময়’
*
ফারিহার ফোনে রেসপন্স না পেয়ে তূর্য ওর বাসার সামনে গাড়ি থেকে নেমে দেখল –
মেয়েটা ভিজছে ।