পরিবারের সবার জন্য বাড়িতে আলাদা আরামদায়ক জায়গা রাখার ধারণা খুব একটা পুরোনো নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘লিভিং’ শব্দটির উদ্ভব। অবশ্য ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগের আগে এটি ‘পারলার’ নামেই পরিচিত ছিল। কী হতো সেই পারলারে? ফরাসি শব্দ থেকে উদ্ভূত ‘পারলার’ শব্দটি ব্যবহার করা হতো এমন এক জায়গা বোঝাতে, যেখানে পরিবারের এবং পরিবারের বাইরের সবার সঙ্গেই বসে কথা বলার সুযোগ রয়েছে। স্থাপত্যশৈলী, আকর্ষণীয় অন্দরসজ্জা, দারুণ সব হাতের কাজসহ নানান শিল্পে-শৈলীতে সাজানো হতো পারলারটি।
র্যাডিয়েন্ট ইনস্টিটিউট অব ডিজাইনের প্রধান গুলসান নাসরীন চৌধুরী বলেন, ‘আড্ডা-গল্প কিংবা চা আর ঝালমুড়ি খাওয়ার মতো আয়েশি সময়ের জন্যই লিভিং রুম।’ ভারিক্কি ধাঁচের আসবাব এখানে না রাখাই ভালো। বাড়ির সদস্যদের বয়সের ভিত্তিতে লিভিং রুমে বসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। লিভিং রুমটি সাজানোর সময়ই উঠতি বয়সী, মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক সদস্যদের আরাম ও স্বস্তির দিকটি খেয়াল রাখতে হবে।
খাবার ঘর পার হয়ে একটা আলাদা জায়গায় লিভিং রুম করা হয়; সাধারণত বাড়ির সবার শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে ছোট একটা জায়গা থাকে লিভিং হিসেবে। বিনোদনের অংশ হিসেবে লিভিং রুমে একসময় জায়গা পেয়েছে রেডিও, ছোট্ট একটা টেলিভিশন, সিনেমা দেখার জন্য প্রজেক্টর, এমনকি ফ্যাক্স মেশিন পর্যন্ত। তবে অন্য কিছু না হলেও একটা সময় মার্কিনদের ৯০ শতাংশ বাড়িতে একটি করে টেলিভিশন থাকত; আর বেশির ভাগ বাড়িতেই সেটি থাকত লিভিং রুমের কেন্দ্রবিন্দুতে।
গুলসান নাসরীন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বাড়িতে সবাই মিলে আড্ডা দিলেও সেখানে টেলিভিশন চালানো চাই অবশ্যই। তাই লিভিং রুমের একটি উপযুক্ত স্থানে টেলিভিশন রাখা ভালো। ছোট ফ্ল্যাট বাড়িতে লিভিং রুমের জায়গা কম থাকে। অনেক সময় আলাদা কোনো ঘরও পাওয়া যায় না, শুধু ছোট একটা জায়গা থাকে। জায়গা কম থাকলে দেয়ালে এলইডি টেলিভিশন রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া টেলিভিশনের নিচে অল্প জায়গায় ছোট শেলফে বই, সিডি, ডিভিডি অথবা বাচ্চাদের গেম খেলার টুকটাক জিনিস রাখতে পারেন।’
হোম থিয়েটার রাখা যায় বসার এই ঘরটায়। বাচ্চারা ধুম-ধাড়াক্কা গানও বাজাতে পারবে, চাইলে আড্ডার ফাঁকেও শোনা যাবে হালকা রবীন্দ্রসংগীত; আবার সবাই মিলে একসঙ্গে বসে মজার কোনো সিনেমাও দেখা যাবে। তবে হোম থিয়েটার রাখতে চাইলে বাড়ি তৈরির সময়ই সেটির জন্য কিছু ব্যবস্থা নিয়ে রাখা ভালো। হোম থিয়েটারের আনুষঙ্গিক তার (কেব্ল) গুছিয়ে রাখার জন্য দেয়ালের ভেতরে একটি প্যানেল করে রাখতে পারেন, এ ব্যবস্থা করে রাখলে তারগুলো এলোমেলোভাবে পড়ে থাকবে না।
বসার ব্যবস্থা নিয়ে কথা হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ফিজিক্যাল মেডিসিন ও রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেলী রহমানের সঙ্গে। তিনি জানালেন, বসার জন্য ফোম খুব একটা ভালো নয়। শক্ত ভিতের ওপর বসাটাই স্বাস্থ্যসম্মত।’
লিভিং রুম সাজাতে জেনে নিন তাঁর পরামর্শ
l টেলিভিশন এমন উচ্চতায় রাখা ঠিক নয়, যাতে ঘাড় উঁচু করে টেলিভিশন দেখতে হয়।
l ফোম বা নরম গদিতে বসা ঠিক নয়। এতে কোমর ব্যথা হতে পারে।
l খুব নিচু বা লো হাইটের আসবাব ব্যবহার করা ঠিক নয়, ক্রমাগত এগুলো ব্যবহারের ফলে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
লিভিং রুমের এক পাশে এমনভাবে বসার ব্যবস্থা রাখতে হবে, যেন পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিরা আরাম করে বসতে পারেন। নিচু আসবাব কিংবা ফ্লোরে কুশন নিয়ে বসার ব্যবস্থা থাকলে তা তাঁদের জন্য অস্বস্তির হতে পারে। যাঁদের জন্য বসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তাঁর উচ্চতা এবং শারীরিক অবস্থার কথা খেয়াল রাখতে হবে। ঘরের এক পাশে ভারী ম্যাট্রেস বিছিয়ে রাখতে পারেন, যেখানে উঠতি বয়সীরা কুশন কোলে নিয়ে আয়েশ করে বসতে পারে। অন্য এক পাশে স্বাভাবিক উচ্চতার একটি ডিভান বা তিনজন বসার উপযোগী একটি সোফা রাখা যায়। জানালেন গুলসান নাসরীন চৌধুরী।
লিভিং রুমে যদি জানালা থাকে কিংবা এর পাশে যদি বারান্দার কোনো অংশ থাকে, তাহলে সেখানে ভারী পর্দা লাগানো প্রয়োজন। রোদ এলে বা যেকোনো প্রয়োজনে পর্দাটি যেন সহজেই সরানো যায়, সে ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
বসার ঘরের দেয়ালে বড় একটি ফটোফ্রেম তৈরি করে নিয়ে পারিবারিক গ্যালারি সাজানো যেতে পারে। স্বাভাবিক উচ্চতার দেয়ালের মাঝ বরাবর একটি ছয় ফুট বাই দুই ফুট মাপের ফটোফ্রেম রাখা যায়। ফটোফ্রেমের মাঝে ড্রিল করে, হুক বানিয়ে নানান আকারের ছবি সাজিয়ে কোলাজ করতে পারেন। আলাদাভাবে ছবিগুলোর প্রতিটিতে ফ্রেম লাগাতে পারেন, ছবিগুলোর ফ্রেম আর মূল ফ্রেমের ডিজাইন একই হলে তা আরও দৃষ্টিনন্দন হবে। পরিবারের সদস্যদের ছোট্টবেলার ছবি, বিয়ের ছবি বা বিশেষ কোনো অর্জনের মুহূর্তের ছবি রাখলে তা পরিবারের সবার জন্যই সুখকর হবে।
লিভিং রুমের একটি কোণে জায়গা থাকলে মাটির পাত্রে রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপা ফুল রাখতে পারেন। অনেকে আবার কৃত্রিম ফুলও সাজিয়ে রাখেন। আজকাল এমন অনেক কৃত্রিম ফুল পাওয়া যায়, যেগুলো দেখতে সত্যিকারের ফুলের মতোই লাগে। হালকা নকশার ল্যাম্পশেড রাখতে পারেন এক কোণে, চাইলে ঝোলানো ল্যাম্পশেডও রাখতে পারেন। ল্যাম্পশেডের আলোর উজ্জ্বলতা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা ভালো, তাহলে প্রয়োজনমতো উজ্জ্বলতা কমিয়ে-বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। ঘরটির অন্যান্য আসবাবের উপকরণের সঙ্গে মিল রেখে ল্যাম্পশেডের উপকরণ বেছে নিতে পারেন (রট আয়রন, কাঠ, বেত ইত্যাদি)। একটু বেশি জায়গা থাকলে অন্দরসজ্জার উপযোগী গাছও রাখতে পারেন লিভিং রুমে।