কংক্রিটের অরণ্যে স্রোতস্বিনী নদী

কংক্রিটের অরণ্যে স্রোতস্বিনী নদী

newyork-river
কংক্রিটের অরণ্যে স্রোতস্বিনী নদী
যারা অরণ্য দেখেছেন, তারা আমার মতো মুগ্ধ কিনা জানি না। প্রকৃতি তার নিজের মতো করেই অপার সৌন্দর্যে সবকিছু সাজিয়ে দেয়। অরণ্যও তারই একটি।
গাছের পর গাছ, সবুজ আর সবুজের শৃঙ্খলাই তো অরণ্য! সে অরণ্যে আমি সবসময়ই মোহিত হই, গাছ ভালোবাসি বলে। আর অরণ্য ভালো লাগে, প্রাকৃতিকভাবে গজিয়ে ওঠা গাছেদের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দেখে।
নিউ ইয়র্ককে আমি বলি ‘কংক্রিটের অরণ্য’। এই শহরে অনেক বেশি সুউচ্চ ভবন। দেখলে মনে হয় গায়ে গায়ে লাগানো। তার মধ্যেও এক ধরনের নান্দনিকতা আর শৃঙ্খলা রয়েছে। ফলে দূর থেকে ম্যানহাটনের সেই কংক্রিটের অরণ্য দেখতে খুব ভালো লাগে আমার। আর তা যদি হয় স্রোতস্বিনী নদীগর্ভ থেকে দেখা, তাহলে তো কথাই নেই।
নিউ ইয়র্কের চারপাশ জুড়েই কেবল নদী। বলে রাখা ভালো, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক হারবার বা পোতাশ্রয় এই শহরেই অবস্থিত। ফলে নদী আর মহাসমুদ্রের মিলনস্থলে গড়ে ওঠা এই শহরটি অনেক ঘনবসতিপূর্ণ হবার পরও সুন্দর।
new-york-2
নদী আমার ভালো লাগে। উপভোগ করি নদীপথের যাত্রাও। আর হঠাৎ করেই নিউ ইয়র্কের নদী পথটা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়ে গেল। অবশ্য যে কেউ চাইলে এই নদী পথে এমনিতেই ঘুরে বেড়াতে পারেন। বিশেষ করে সামারে। এটি নিউ ইয়র্কের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। অনেক কোম্পানি অর্থের বিনিময়ে পর্যটকদের নদী পথটা ঘুরে দেখায়, থাকে নানা আয়োজন।
নিউ ইয়র্কে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন আমেরিকা-বাংলাদেশ প্রেসক্লাব নৌবিহারের আয়োজন করেছে। সাংবাদিক স্বামী শামীম আল আমিনের কারণেই আমাদের এবারের যাত্রা। সাথে আমাদের রাজকন্যা অপর্ণা আর টিবিএন২৪ টেলিভিশনের সিনিয়র ক্যামেরাপার্সন রফিক ভাই।
ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনা থেকে প্রমোদতরী ছাড়বে সকাল ১০টায়। আমরাও সময়মতোই সেখানে পৌঁছে গেলাম। প্রমোদতরী রাখার এই ঘাটটি কুইন্সের ফ্লাশিং বে’তে অবস্থিত। জায়গাটা ফ্ল্যাশিং মেডো ও করোনা পার্কের মাঝামাঝি। এটির ঠিক উল্টো দিকেই বিখ্যাত সিটি ফিল্ড আর ইউএসটিএ বিলি জিন কিং ন্যাশনাল টেনিস সেন্টার।
ন্যাশনাল টেনিস সেন্টারটি হচ্ছে পৃথিবী বিখ্যাত ইউএস ওপেন টুর্নামেন্টের ঘর। তখন ইউএস ওপেন টেনিসের আসর বসেছে। পৃথিবী বিখ্যাত তারাকারা সেখানে খেলছেন। তাই আয়োজন ও নিরাপত্তার কড়াকড়িটাও বেশ ভালোভাবেই চোখে পড়লো।
নিউ ইয়র্কের ডিপার্টমেন্ট অব পার্কস অ্যান্ড রিক্রিয়েশনের অধীনে পরিচালিত মেরিনাটি। ঘাটে নোঙর করা জাহাজে উঠে পড়লাম চটপট। সময়মতোই ছাড়লো জাহাজটি।
নীল আকাশে ঝকঝকে রোদ। মেঘেদের আনাগোনা নেই। তির তির করে নদীর পানি কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে নৌযানটি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখে পড়লো লাগোর্ডিয়া এয়ারপোর্ট। উড়োজাহাজ ওঠা-নামার দৃশ্য অপূর্ব লাগছিল। খুব নিচ দিয়ে উড়োজাহাজগুলো চলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই যেন ছুঁয়ে দেখা যাবে।
এই নৌপথটি এমনভাবে এঁকে বেঁকে এগিয়ে চলেছে, যেখান দিয়ে যাবার সময় নিউ ইয়র্কের পাঁচটি বরো’র প্রত্যেকটির কিছু না কিছু অংশ দেখা যায়। চোখে পড়ে নিউ জার্সি স্টেটের স্থলভাগও।
পাঁচটি কাউন্টি নিয়ে নিউ ইয়র্ক গঠিত। এই কাউন্টিগুলোকে বলা হয় বরো। এগুলো হচ্ছে ম্যানহাটন, ব্রুকলিন, ব্রঙ্কস, কুইন্স এবং স্ট্যাটেন আইল্যান্ড।
হাডসন এবং ইস্ট রিভারের মাঝের একটি দ্বীপজুড়ে অবস্থিত ম্যানহাটন। স্ট্যাটেন আইল্যান্ডওসম্পূর্ণ পানি দিয়ে ঘেরা। ব্রঙ্কস ছাড়া বাকি দুটো বরো পেয়েছে জলের ছোঁয়া। ফলে বোঝাই যাচ্ছে নিউ ইয়র্কে নদীর প্রাধান্য কতটা।
হাডসন নদীকে নর্থ রিভার নামেও ডাকা হয়। বয়ে চলেছে ইস্ট রিভারসহ আরও কয়েকটি নদী। এই যাত্রা পথে এই দু’টি নদী দেখা হবে। হারলেম রিভারেরও একটু স্পর্শ থাকবে। একথা আগেই শুনেছি। সেই পথে যাত্রা শুরু করেছি।
জাহাজে যারা সফর সঙ্গী তাদের বেশিরভাগই পেশায় সাংবাদিক বা তাদের নিকটজন। ফলে কমবেশি প্রায় সবাই পরিচিত। আছে নানা ধরনের আয়োজন। খাবার-দাবারের অভাব নেই।
তিনতলায় চারিদিকটা খোলা। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। দোতালা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। গরমে অনেকে সেখানেও আশ্রয় নিয়েছে। আমি ডেকে দাঁড়িয়ে নদী পথের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে খুব ভালো লাগছে এই যাত্রাপথটি।
স্বচ্ছ স্ফটিক জল, পরিষ্কার। কি যে স্রোতস্বিনী। কুলকুল করে বয়ে চলেছে নদীর পানি। নিশ্চিত মিশেছে মহাসাগরে। নদীর বুকে চমৎকার বাতাস, এলো চুল, আরো অগোছালো করে দিচ্ছে। শান্তি শান্তি ভাব।
দু’পাশে উঁচু উঁচু ভবনের সারি। সবকিছু পরিকল্পিত। ভবনগুলো দেখে এতোটাই গোছানো লাগছে যে মনে হচ্ছে যেন কোনো শান্ত বুদ্ধিমান শিশু বুঝি মনের মাধুরি মিশিয়ে লোগো সেট দিয়ে বানিয়েছে এগুলো। তার মাথায় আছে, অসাধারণ পরিকল্পনা। তারই ছাপ চারিদিকে।
ভবনের সারির ফাঁকে ফাঁকে সবুজের আধিক্য। শহরের বুক জুড়েও গাছের সারি। কখনো দেখা মিলছে লম্বা পার্কের।
নদীর উপর দিয়ে চলে যাওয়া অসাধারণ এক একটি ব্রিজ চোখে পড়ছে। ব্রিজের নিচ দিয়ে চলে যাচ্ছে নৌযানটি। তখন উপরের দিকে তাকিয়ে ব্রিজটিকে দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে।
দূর থেকে চোখে পড়ছে অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। উঁচু ভবনগুলো থেকে মাথা বের করে আছে। একটুপরই দৃষ্টির সীমানায় চলে এলো জাতিসংঘ ভবন। খুব কাছ থেকে দেখা ভবনটিকে নদীর বুক থেকে আরও ভালো লাগলো।
নদীতে হাজারো রকমের নৌযান। পালতোলা নৌকাও চোখে পড়লো। সাহসি মানুষেরা স্পিডবোর্ড, ওয়াটার ট্যাক্সি নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর ছোট ছোট প্রমোদতরীতে হাজারো মানুষ তখন ভেসে বেড়াচ্ছে নদীর বুকে।
একটু পরেই দেখা মিলল ফ্রিডম টাওয়ারের। এখানটাতেই একসময় ছিল বিখ্যাত সেই টুইন টাওয়ার। সেখানেই নতুন করে নির্মাণ করা ওয়ান টাওয়ার বা ফ্রিডম টাওয়ার। এর নির্মাণশৈলীও অত্যন্ত চমৎকার ও আধুনিক। ১০৪ তলা ভবনটি এখন পুরো পৃথিবীর মধ্যে চতুর্থ উচ্চতম। এর ১০২ তলা পর্যন্ত যাওয়া যায়। লিফটে যেতে লাগে মাত্র ৬০ সেকেন্ড। যেখানে ওঠার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
কিছুক্ষণ পরেই উন্মুক্ত জলরাশির মতো একটি জায়গা চোখের সামনে ভেসে এলো। চারিদিকে অথৈ পানি। আর মাঝখানে ভেসে আছে ছোট ছোট কয়েকটি দ্বীপ। স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের সীমানা চোখে পড়ছে। দেখা যাচ্ছে অ্যালিস আইল্যান্ড। তবে সবকিছু ছাপিয়ে দৃষ্টি চলে গেল স্ট্যাচু অব লিবার্টির দিকে। আমাদের প্রমোদতরীটা এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে। উপস্থিত সবার মাঝে এক ধরনের চাঞ্চল্য চোখে পড়লো। আনন্দে কেউ চেচিয়ে উঠছেন, কেউবা দিচ্ছেন হর্ষধ্বনি।
জাহাজটা স্ট্যাচু অব লিবার্টির খুব কাছে চলে এলো। একটু দূর থেকে স্ট্যাচুর পুরোটা অংশ দেখতে পেয়ে মনটা ভরে গেল। ফ্রান্সের পক্ষ থেকে আমেরিকাকে দেয়া উপহার এই স্ট্যাচু অব লিবার্টি এখন দেশটির আইকনে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ এটিকে দেখতে আসেন। নদী আর মহাসমুদ্রের মিলনস্থলে সংরক্ষণ করা হয়েছে স্ট্যাচুটি। জায়গাটার নাম দেয়া হয়েছে লিবার্টি আইল্যান্ড।
এর আগেও লিবার্টি আইল্যান্ডে এসেছি আমি। সেবার অন্যভাবে আসা হয়েছিল। যা নিয়ে আলাদা একটি লেখা দেবার ইচ্ছা আছে আমার।
স্ট্যাচু অব লিবার্টির পাশ ঘেঁষে আমাদেরকে বহনকারী প্রমোদতরীটি ঘুরে গেল। অর্থ্যাৎ যে পথে এসেছি, সেই পথে এবার ফেরার পালা। এলে যেতেও হয়।
এতক্ষণ কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল সৌন্দর্যের পসরায় তলিয়ে আছি। ফেরার কথা মনে উঠতেই মনটা একটু খারাপও হয়ে গেল। তবে ভাবলাম, আবার আসবো। আর যে পথে আসা, সেখান দিয়েই তো ফেরা। আরও একটু উপভোগ করা যাক না।
নবীনতর পূর্বতন