অযান্ত্রিক গ্রাম: অ্যামিশ ভিলেজ
রাস্তার পাশে একটা গির্জা। দৃষ্টিনন্দন। সামনের মাঠে ছোট্ট একটা গ্রাম্য মেলা বসেছে। এ ধরণের মেলাকে এখানে বলা হয় ‘ইয়ার্ড সেল’।মাঠের এক পাশে সাবেকি ধরণের কয়েকটি ঘোড়ার গাড়ি রাখা। পাশেই বেধে রাখা বেশ কয়েকটি তাগড়া বলশালি ঘোড়া। দেখে, অপর্ণা প্রায় চিৎকার করে উঠলো, ‘মা মা ঘোড়া’।
গাড়ির গতি কমে গেল। এক পর্যায়ে গাড়িটা থামিয়েই ফেললেন শরীফ ভাই। এরপর মাঠের দিকে গাড়ির মাথাটা ঢুকিয়ে দিলেন। সুবিধাজনক জায়গায় পার্কও করা হলো। বললেন, ‘নেমে পড়ো, চলো ঘোড়া দেখি’। খুশিতে হাতে তালি দিয়ে উঠলো অপর্ণা। মাঠে নানা ধরণের কুটির শিল্প ও হস্তশিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছে এক দল মানুষ। কেউ কেউ নিয়ে এসেছেন, নিজের ক্ষেতে ফলানো সবজি ও ফলমূল। তাদের পোশাক দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে, অ্যামিশ ভিলেজে ঢুকে পড়েছি আমরা। সেখান থেকে অপর্ণা হাতে তৈরি সুন্দর একটি খেলনা কিনে নিল। এরপর আবারো আমাদের যাত্রা, গ্রামের ভেতরের দিকে।
চারিদিকে যেন সুন্দরের মেলা বসেছে। সবুজ আর সবুজ। ছেলেবেলায় বিটিভির সাদাকালো যুগে দেখা কোন হলিউড মুভির দৃশ্য যেন। কেবল তাতে রঙ লেগেছে, এই যা। পিচঢালা মসৃণ রাস্তা। আর তার দু’পাশে মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ন ফসলের ক্ষেত। ভুট্টা, আলু আরও কত কি! চোখে পড়ছে দিগন্তবিস্তৃত গরুর খামার।
কোথাও কোথাও চোখে পড়ছে, ঘোড়া দিয়ে চাষের ক্ষেত তৈরি করা হচ্ছে। ঘোড়াচালিত গাড়ি বা ওয়াগন চলে যাচ্ছে। দেখে মন জুড়িয়ে গেল। কোথাও কোন প্রযুক্তির ব্যবহার নেই। অথচ এটি পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের একটি গ্রাম। অ্যামিশ ভিলেজ।
যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে থেকেই মনের ভেতরে গভীর আগ্রহ নিয়ে, অপেক্ষায় ছিলাম, অ্যামিশ ভিলেজে যাবো। আমার মনের ভেতরে যেমন পৃথিবী লালন করি, মনে হতো এই গ্রাম যেন তেমনি। এবার সত্যি হলো, বহুদিনের স্বপ্ন। সঙ্গে স্বামী সাংবাদিক শামীম আল আমিন, মেয়ে অপর্ণা আর শরীফ ভাই।
গাড়ি এগিয়ে চলেছে, গ্রামের ভেতরের দিকে। এই পথে গাড়িটাকেই বড্ড বেমানান লাগছে। কিছুই করার নেই, যেতে হবে, তাই যাওয়া। চলেছি আমরা যন্ত্রচালিত যানে, যন্ত্রহীন গ্রামে।
দুই.
আমরা যেখানে পৌঁছলাম, সেখানে কয়েকটি দিকে সাদা জমিনে কালোতে লেখা রয়েছে, ‘দ্য আমিশ ভিলেজ’। এখানে একটি বড় বাড়িতে, অ্যামিশদের জীবনযাত্রা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা রয়েছে। টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়। একজন গাইড ভেতরে নিয়ে গিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখায়। সেই সাথে অ্যামিশদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়।। আমরা টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বিশ বাইশ বছরের এক সুন্দরী তরুণী আমাদের গাইড। সে আমাদেরকে জানাচ্ছে অ্যামিশদের সম্পর্কে।
অ্যামিশরা মোটর যানের বদলে, ঘোড়ার গাড়িতে চলাচল করে। বিদ্যুৎ ব্যবহার করেনা। নিজেদের কাপড় নিজেরাই তৈরি করে। অ্যামিশ মেয়েরা এক রঙা পোশাক পরে। পোশাকেও ঐতিহ্যবাহী স্বকীয় ভাব বজায় রাখা হয়। পা পর্যন্ত ঝুলের ম্যাক্সি ধরণের লম্বা হাতার জামা, তার ওপর অ্যাপ্রোন দেওয়া। ছেলেদের পোশাকে সাদা, কালো, ব্রাউন এই তিনটি মাত্র রং থাকে।
আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি। প্রথমে দেখানো হলো অ্যামিশদের বাড়ির ভেতরটা কেমন হয়। আমাদের গাইড ঘুরে ঘুরে অ্যামিশদের সম্পর্কে নানা তথ্য জানাচ্ছে। তারা রাতে এখনও সেই মোমের বা তেলের বাতি জ্বালায়। শীতের সময় কেবল কাঠের চুল্লি দিয়ে ঘর গরম করে।
নিজেদের মধ্যে বিশেষ মৌসুমে বিয়ে করে অ্যামিশরা। সেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নিজেদের ঐতিহ্য মেনে দীর্ঘসময় ধরে চলে। বিবাহিত পুরুষ বোঝানোর জন্যে বিয়ের পর দাড়ি রাখে তারা। এখনকার যুগেও প্রতি ঘরে অনেক বেশি সংখ্যক সন্তান। সন্তানের জন্মও হয় বাড়িতে।
বাড়ির ভেতরটা দেখা শেষ হতেই চলে এলাম বাইরে। সেখানে অ্যামিশদের জীবনযাত্রার নানা উপকরণ থরে থরে সাজানো রয়েছে। সেখানে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়া, আস্তাবল, হাঁস, মুরগীর খামার, ফসলি জমি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অ্যামিশদের হাতে তৈরি হস্তশিল্প, জ্যাম, জেলি, পাইয়ের দোকান রয়েছে ভেতরে।
দেখলাম, কিনলাম অনেক কিছু। সাধারণ অর্থে প্রতিটি জিনিসের দাম অনেক বেশি। তবে তৈরি প্রক্রিয়ার কথা ভাবলে বেশি দাম গায়েই লাগবে না।
অ্যামিশদের সন্তানরা স্কুলে যায়। তবে সেই স্কুলের পাঠ খুব বেশি দূর এগোয় না। একটি মাত্র কক্ষে সেই স্কুলে পড়ানো হয় এইট পর্যন্ত। তারা বিশ্বাস করে জীবন ধারণের জন্যে এটুকু শিক্ষাই যথেষ্ঠ।
যতই দেখছি, অ্যামিশদের জীবন সম্পর্কে আরও জানার তৃষ্ণা বেড়ে যাচ্ছে। এই ইন্টারনেটের যুগে কিভাবে তারা এখনও নিজেদের সেই জীবনধারা ধরে রেখেছে, ভেবে ভেবে অবাকই হলাম।
তিন.
সবুজ ফসলের ক্ষেতে তখন বিকেল নেমে এসেছে। নরম হতে শুরু করেছে সূর্যের আলো। আমরা গাড়ি নিয়ে দেখতে বের হয়েছি অ্যামিশদের জীবনযাত্রা। দেখলাম অ্যামিশ নারী পুরুষদের অনেকে ফসলের ক্ষেতে কাজ করছেন। অনেকে বের হয়েছে ঘোড়ার গাড়িতে বেড়াতে। চারিদিকে নিস্তব্ধ নিরবতা। হঠাৎ মোটরের শব্দ তুলে গাড়ির চলাচল নিরবতা ভাঙে। তখন সচকিত হয়ে, কিছুটা হয়তো বিরক্ত হয় গ্রামের মানুষ। কিন্তু সেটাও তারা প্রকাশ করে না। তারা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় এবং ধার্মিক। যতই দেখছি, মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।
অ্যামিশদের প্রধান পেশা কৃষিকাজ। মাঠে ফসল ফলিয়ে নিজেদের প্রয়োজন মেটায় তারা। অতিরিক্ত ফসল বিক্রি করে সুপার মার্কেটে। অনেক জমিজমা থাকায় বেশিরভাগ অ্যামিশ পরিবার মোটামুটি ধনী বলা চলে। কৃষির পাশাপাশি অনেকের পেশা কাঠমিস্ত্রি। কেউ কামার, কেউ কুমার।
কিন্তু এই অ্যামিশদের পেছনের গল্পটাই বা কি? খুব কৌতুহল হলো জানতে। ইন্টারনেট ঘেটে জানার চেষ্টা করলাম। সবচেয়ে প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী জানতে পারলাম, সুইজারল্যান্ডের অ্যানব্যাপটিস্ট গির্জা থেকে অ্যামিশদের আবির্ভাব। তাও সেই অনেক অনেক আগে। ১৬০০ সালের দিকে।
জ্যাকব আম্মান নামে একজন অ্যানব্যাপটিস্ট ছিলেন। তাকে অনেকেই অনুসরণ করতেন। সেই অনুসারীদের নিয়ে তিনি তার গোত্র থেকে আলাদাভাবে থাকতে শুরু করলেন। তারাই অ্যামিশ গোত্র নামে পরিচিতি পায়।
এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার বিভিন্ন জায়গায় অ্যামিশদের বসতি রয়েছে। তবে তাদের সবচেয়ে বেশি বসবাস যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার ল্যাংকেস্টার কাউন্টিতে। এই জায়গাটিই ‘অ্যামিশ ভিলজ’ নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, তাদের প্রথম দলটি ল্যাংকেস্টার কাউন্টিতে ১৭৩০ সালের দিকে আসে। পেনসিলভানিয়া ছাড়াও ওহাইও, আইওয়া, ইন্ডিয়ানাতে তাদের বসতি রয়েছে। নিউ ইয়র্কের আপস্টেটের দিকেও তাদের দেখা যায়। তাদের বসবাস রয়েছে কানাডার অন্টারিওতেও।
আধুনিক সভ্যতা টানে না অ্যামিশদের। গোত্রের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে ভালোবাসে তারা। অপরাধ প্রবণতা নেই বললেই চলে। গির্জা ও পারিবারিক সম্পর্ক তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ-বিগ্রহ খুব অপছন্দ। শান্ত প্রকৃতির মাঝে চলে তাদের যাপিত জীবন। প্রতিদিন হাজারো মানুষ আগ্রহ নিয়ে অ্যামিশদের জীবনযাত্রা দেখার জন্যে আসে। তাতে হয়তো অ্যামিশদের স্বাভাবিক নিভৃতচারী জীবনে ছন্দপতন হয়, কিন্তু তাতেও বোধ করি কোন দু:খবোধ নেই তাদের। কোন অভিযোগ নেই। নিজেদের মতো করেই চলছে তাদের জীবন।
লেখক: আশরাফুন নাহার লিউজা, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক থেকে। ইয়োগা আর্টিস্ট, লেখক ও উপস্থাপক।