শ্নোনেংপেডেং জাফলংয়ের ওপারে

শ্নোনেংপেডেংয়ে জাফলংয়ের মতো স্বচ্ছ পানি, নীচে পাথর। ছবি: লেখকশ্নোনেংপেডেংয়ে জাফলংয়ের মতো স্বচ্ছ পানি, নীচে পাথর। ছবি: লেখকমেঘালয়ের ডাউকির ছোট্ট গ্রাম শ্নোনেংপেডেং। অখ্যাত এই গ্রামটিই হয়ে উঠেছে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। কী আছে ছোট্ট এই গ্রামে?
প্রথম ছবিটা দেখি পানির নিচের, দেখেই মুগ্ধ! এত সুন্দর। বাকি ছবিগুলোর সঙ্গে জাফলংয়ের অনেক মিল। গত জুলাইয়ে ঘুরে আসি শিলং, ভিসার মেয়াদ এখনো কয়েক মাস বাকি। এদিকে নাফিজ ভাই ঘোষণা দিয়ে দিলেন মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকায় ঘুরে আসা সম্ভব। ভারতীয় ভিসা ছিলই, সিদ্ধান্ত নিলাম যাওয়াই যাক। নতুন একটা স্নোরকেলিং সেট আনিয়েছি যুক্তরাষ্ট্র থেকে, একবার মাত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। সেটারও একটু ব্যবহার হয়ে যাবে।
গত মাসে পাঁচজন মিলে রওনা দিলাম শ্নোনেংপেডেংয়ের উদ্দেশে। ঢাকা থেকে শ্যামলী পরিবহনে সিলেট পৌঁছালাম ভোরবেলা। সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে চলে গেলাম তামাবিল সীমান্তে। অনেক ব্যস্ততা সেখানে, একটু আগে পৌঁছেছে শ্যামলীর শিলংগামী বাস। আমাদের অপেক্ষা করতে বলল। অবশেষে প্রায় এক ঘণ্টা পরে সকাল সাড়ে আটটার দিকে আমাদের ডাক পড়ল। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের কাজ শেষ হলো। ওপারের ভারতীয় ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে আরও এক ঘণ্টা শেষ। এরপর ট্যাক্সি নিয়ে মাত্র বিশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। যেখানে গাড়ি থেকে নামলাম। সেখানে একটা ছোট্ট হোটেলের সঙ্গে কথা বলে কটেজ দেখতে পাহাড় থেকে নিচে নেমে এলাম। নামার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলাম কিসের আকর্ষণে ছুটে আসছেন পর্যটকেরা।
পাহাড়ি নদী উমংগট। তার পাশে পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট কটেজ। একটা কটেজ পছন্দ করে উঠে পড়লাম আমরা। সেই কটেজের জানালা খুললেই দেখা যায় নদীর অপরূপ দৃশ্য। দুপুরে খাবারের অর্ডার দিয়ে নুডলস খেয়ে বের হয়ে পড়লাম। নৌকার মাঝি ফ্রাংক আমাদের গাইড, চমৎকার বাংলা ও ইংরেজি বলে সে। স্নোরকেলিং করার জন্য তর সইছিল না আমার। বলার অপেক্ষা রাখে না, মাত্রই শিখেছি আমি। দলের বাকি সবাইকে নিয়ে রওনা দিলাম ঘাট থেকে। সবাইকে বাধ্যতামূলক লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দেওয়া হলো। ফ্রাংক চালাচ্ছে নৌকা। জায়গাটা জাফলংয়ের মতো। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বেশি, আর পর্যটকের সংখ্যা অনেক কম। স্বচ্ছ নদীর তলদেশ দেখা যাচ্ছে অনেক জায়গায়। নদীর ওপর একটা বেইলি ব্রিজ, দুজন মানুষের বেশি একসঙ্গে হাঁটা যাবে না এ ধরনের প্রশস্ত। নদীর ওপাশের গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে এই বেইলি ব্রিজটি। নদীর এক পাশে নৌকা থামাল ফ্রাংক, স্নোরকেলিং করার জন্য জায়গা দেখিয়ে দিয়ে গেল।
সময় গড়িয়ে দুপুর তখন। ঝকঝকে রোদ নদীর অনেক গভীরে পৌঁছে দিচ্ছে আলো। নেমে পড়লাম স্নোরকেলিংয়ে, অসাধারণ দৃশ্য। শুধু মাছের সংখ্যা খুব কম, ভাবলাম পাহাড়ি নদী, মাছের সংখ্যা তো কম হবেই। কিছুক্ষণ নদীতে মাছ তাড়িয়ে গেলাম জিপ লাইনিং করতে। একটিমাত্র তারের সঙ্গে হার্নেস বেঁধে পার হতে হবে নদী। একটু একটু ভয় লাগছিল, কিন্তু সবার আগেই রওনা দিলাম। পরিষ্কার ইংরেজিতে গাইড বুঝিয়ে বলল কী করতে হবে। তারপর হার্নেস পরিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিল। কয়েক মুহূর্তেই পার হয়ে চলে গেলাম নদীর ওপারে। সেখানে ক্লিপ জাম্পিংয়ের ব্যবস্থা আছে। অত ওপর থেকে ঝাঁপ দেওয়ার সাহস হলো না আর।
ঘণ্টা খানেক পরে ফ্রাংক ফিরে এসে আমাদের নিয়ে গেল নদীর আরও উজানে। বড় বড় পাথরের মধ্যে অত্যন্ত সাবধানে নৌকা চালাচ্ছে। জায়গাটার শেষ ভাগে একটি জলপ্রপাত। বড় বড় পাথরের বোল্ডারের মধ্য থেকে পানি বের হয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীতে। এ জায়গার সৌন্দর্য বলে বা ছবি দেখিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। বড় বোল্ডারের ওপরে কিছু মৎস্যজীবী মানুষ মাছ ধরছে বড়শি দিয়ে। এই গ্রামে মাছের অনেক দাম, কেজি ৬০০ রুপি। রসিকতা করে ফ্রাংককে বললাম, আমাদের বললেই তো মাছ নিয়ে আসতাম তোমাদের জন্য।
 কটেজে ফিরে আসতেই ফ্রাংক খাবার নিয়ে এসে টেবিলে সাজিয়ে দিল। নদীর ধারের টেবিলে বসে খেয়ে নিলাম চমৎকার রান্না করা খাবার। ঘুমে দুচোখ বুজে আসছে, কারণ আগের রাতে ভালো ঘুম হয়নি বাসে, তার ওপর এতক্ষণ পানিতে দাপাদাপি। সবাই শুয়ে পড়লাম। জানালা দিয়ে চোখ গেল বিকেলের শ্নোনাংপেডেং গ্রামের ওপর। এ রকম জায়গায়, এ রকম সময় ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করব তা হতে পারে না। নিচে নেমে এসে নদীর পাড়ে বসে চা খাচ্ছি, আশপাশেই লোকজন তাঁবু ফেলছে, রাতে তাঁবুতে থাকবে তারা। পূর্ণিমা বাকি আছে আরও দুই বা তিন দিন৷ কিন্তু তা বোঝার কোনো উপায় থাকল না। চাঁদের আলো যেন ভাসিয়ে দিচ্ছে পুরো গ্রাম। টর্চ সঙ্গেই ছিল, কিন্তু দরকারই পড়ল না।
নদীটা যেখানে হাঁটুজল হয়ে আমাদের বিছনাকান্দির মতো হয়েছে, সেখানে এসে একটা বড় বোল্ডারের ওপর বসে রইলাম আমরা। সময় যেন থমকে গেল। অপার্থিব জোছনা, পাথর কেটে নদীর ছুটে চলার শব্দ, আর নিস্তব্ধ পাহাড়, সব মিলে যেন অন্য এক পৃথিবী। গ্রামের কয়েকটা ঘরে আলো জ্বলছে, এ ছাড়া কোথাও মানুষের তৈরি আলো নেই। বিধাতা যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই ইলেকট্রিসিটি নিয়ে গেল। পুরো পৃথিবীতে এখন শুধু চাঁদটাই আলো দিচ্ছে মনে হলো। রাত আরও বাড়লে নদীর পাড় থেকে উঠে চলে গেলাম বেইলি সেতুতে। প্রচণ্ড বাতাসে দাঁড়ানোই কঠিন সেখানে। তাই সেতুতেই শুয়ে পড়লাম। এর মধ্যে ফ্রাংক এসে ডেকে নিয়ে গেল রাতের খাবারের জন্য। নদীতে পাওয়া মাছ দিয়েই রান্না হয়েছে। অসাধারণ খাবার। রাতে মরার মতো ঘুমালাম সবাই।
.
সকালে উঠে নাশতা শেষ করেই আবার দৌড় দিলাম পানিতে। আমি ব্যস্ত স্নোরকেলিং নিয়ে, বাকিরা কায়াকিং নিয়ে। একটি কায়াকে দুজন ওঠা যায়, দলের দুজন চলে গেল কায়াক নিয়ে। বাকিরা চেষ্টা করছিলাম পানির নিচের মাছ দেখার জন্য। আগের দিন মাছ তেমন একটা দেখিনি, কিন্তু আজ বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা কী ঘটেছে। সবার আগেই পানিতে নামতে হবে। রোদ বেড়ে গেলে মাছ গভীর পানিতে চলে যায়। ছোটখাটো মাছের খলসে গোত্রের একঝাঁক মাছের দেখা পেলাম। সেই সঙ্গে আরও কয়েক ধরনের মাছ। প্রায় কালো পাথরের রঙের একধরনের মাছ দেখলাম কয়েকটা। হঠাৎ করে এদের শনাক্ত করাও কঠিন, এত সুন্দর করে পাথরের গায়ে লুকিয়ে থাকে। কয়েক মিনিট চলার পর গত রাতে খাওয়া ট্রাউট ধরনের মাছগুলোকে দেখলাম। এরা ২০০-২৫০ গ্রাম ওজনের হবে, মোটামুটি নিরাপদ দূরত্ব বসিয়ে রেখেছে। এদিকে এক ঘণ্টার বেশি স্নোরকেলিং করে আমার রীতিমতো ঠান্ডা লাগছে, তাই ওপরে উঠে এলাম।
নির্ধারিত সময় শেষ আমাদের, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। এই গ্রামে ছিলাম মাত্র ২৪ ঘণ্টা। তাতেই মনে হচ্ছে কত দিন ধরে আছি আর কত কিছু করে ফেলেছি।
থাকা-খাওয়াথাকার জন্য রয়েছে দুই ধরনের ব্যবস্থা। কটেজে থাকলে ভাড়া পড়বে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ রুপি। আর তাঁবুতে থাকলে ৭০০ রুপি। বোটে করে জলপ্রপাতের কাছাকাছি যেতে পারেন। বোটিংয়ের জন্য নির্ধারিত সময় সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা। অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরতে হবে। কায়াক ভাড়া পাওয়া যায়।
নবীনতর পূর্বতন