দেখে এলাম হা লং বে
হো চি মিনের দেশ ভিয়েতনাম। এর উত্তর-পূর্ব উপকূলজুড়ে হা লং বে। এটি পৃথিবীর সুন্দরতম স্থানগুলোর একটি। আমাদের দেশের কক্সবাজার ও সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে শীর্ষ সাতাত্তরের তালিকায় উঠে এসেছে হা লং বে। রাজধানী হ্যানয় থেকে ১৭৫ কিলোমিটার দূরে বাকনিন ও হাইজুন প্রদেশ পেরিয়ে কুয়াঙ নিন প্রদেশে এর অবস্থান। হা লং শব্দের অর্থ অবরোহী ড্রাগন।জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বৃষ্টিস্মাত এক দিনে একটি পর্যটন সংস্থার আয়োজনে হ্যানয় থেকে রওনা দিলাম হা লংয়ের পথে। সাশ্রয়ী প্যাকেজে দুপুরের খাবারসহ জনপ্রতি খরচ ৩০ ডলার। পথসঙ্গী আরও কয়েকজন বিদেশি পর্যটক। পর্যটন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মাতক গাইড হোয়াঙ কোক হ্যাঙ ধারাবিবরণী দিয়ে যাচ্ছেন।
রাস্তায় দুধারের প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য অনেকটা আমাদের মতোই। পথের পাশে হকাররা পাউরুটি, আনারস, ডাব, লিচু, রামবুটান বিক্রি করছেন। চোখে পড়ল ঘন সবুজ ধানক্ষেতের পাশে ইটের ভাটা থেকে ধোঁয়া বেরোনোর দৃশ্য। আবার কিছু জায়গায় ধানের খড় পুড়িয়ে তৈরি হচ্ছে জৈবিক সার। পথের দুধারে দেখা গেল জুতা, বস্ত্র, বিয়ার, স্টিল, কাচসহ বিভিন্ন জিনিসের কারখানা। বিকেলে ফেরার পথে সবচেয়ে মনোহর দৃশ্য চোখে পড়ল ক্যানন ক্যামেরা কারখানার সামনে। শত শত নারীশ্রমিক বর্ণিল রঙের রেইন কোট ও হেলমেট পরে মোটরসাইকেলে বেরিয়ে যাচ্ছেন কাজ শেষে; অনেকটা খাবারের পাত্র হাতে পোশাক কারখানা থেকে যেমন বের হন আমাদের দেশের নারীশ্রমিকেরা। পার্থক্য কেবল জীবনযাত্রার মানের।
সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রাপথ পেরিয়ে হা লং পৌঁছালাম বেলা একটায়। এটি ইউনেসকো ঘোষিত ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’র অন্তর্ভুক্ত। এই নিশ্চল উপসাগরে রয়েছে এক হাজার ৯৬৯টি চুনাপাথরের ক্ষুদ্র দ্বীপ ও পাথুরে টিলা। টিলা-সংবলিত দ্বীপের অনেকগুলোই ভেতরে ফাঁপা। আবার অনেক দ্বীপের মধ্যে রয়েছে হ্রদ। দউ-বে দ্বীপে রয়েছে ছয়টি হ্রদ। এরই ফাঁকে ফাঁকে প্রায় ৪০০ দ্বিতল নৌযান ঘুরে বেড়াচ্ছে পর্যটকদের নিয়ে। নৌযানগুলোর কাঠের কাঠামোয় করা হাতের কাজ চোখে পড়ার মতো। ১২০ কিলোমিটার লম্বা সমুদ্রতটের পূর্বদিকে পর্যটকদের জন্য বিশেষ অঞ্চল আর পশ্চিম দিকে থাকে স্থানীয় অধিবাসীরা, যাদের অনেকেরই পেশা মাছ আহরণ। হা লং বের সমুদ্রতট এক হাজার ৫৫৩ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। এ উপসাগরে ২০০ প্রজাতির মাছ ও ৪৫০ ধরনের ঝিনুক-শামুকের বাস।
আধঘণ্টা মন্থর নৌযাত্রার পর আমরা গেলাম ঘন সবুজ বনে আচ্ছাদিত এক ক্ষুদ্র দ্বীপে। এটি মূলত একটি বড় গুহা, যা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। দ্বীপের নাম থিয়েন চুঙ, যার অর্থ স্বর্গের প্রাসাদ। গুহার বাইরের দিকে আছে তিনটি ফোকর। রঙিন আলো প্রক্ষেপণের মাধ্যমে গুহার ভেতর তৈরি করা হয়েছে ভৌতিক আবহ। থিয়েন চুঙ গুহা থেকে বেরিয়ে ঘর্মাক্ত শরীরে উঠলাম নৌযানের ছাদে। এরই মধ্যে দেখি ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, আকাশে রুপালি মেঘের লুকোচুরি। দুপুরের খাবারের ডাক পড়ল। লোনা জলের হাওয়ায় ভাজামাছসহ সামুদ্রিক খাবারই খেলাম। চলন্ত নৌযানের বাঁ দিকে ফিরতেই দেখা গেল জেলেদের ভাসমান বসতি। প্রায় এক হাজার ৬০০ জেলে বিক্ষিপ্তভাবে গুচ্ছাকারে এখানে বসবাস করে; অনেকটা আমাদের বেদে সম্প্রদায়ের মতো।
তারপর ঘণ্টা দুই আরও উপবৃত্তাকারে ঘুরে ফেরার পথে চোখে পড়ল ১২ মিটার দীর্ঘ বিখ্যাত গা চোই ক্ষুদ্র দ্বীপ। মুখোমুখি মোরগের মাথার মতো দেখায় বলে এর নাম লাংইরত মোরগ বা ‘ফাইটিং কক’। এমন অসাধারণ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এরই মধ্যে দেখি নৌযানের নারীকর্মীরা মুক্তার পসরা সাজিয়ে বসেছেন। তাঁদের পীড়াপীড়িতে পর্যটকদের প্রায় সবাই কিছু না কিছু কিনলেন, তবে দরাদরি করে। হা লং বের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অমূল্য মণিমুক্তা হৃদয়ে ধারণ করে একসময় নৌযান ছেড়ে গাড়িতে উঠলাম আমরা।