নেপাল ভ্রমণের সুখস্মৃতি
যাত্রার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমাদের বিমান যখন নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দর ছুঁই ছুঁই করছিল তখন অন্য রকম অনুভূতি, অন্য রকম শিহরণ বোধ করতে লাগলাম। বেশ কিছুদিন আগে থেকেই নেপালফেরত কয়েকজনের কাছ থেকে দেশটির নয়নাভিরাম রূপের প্রশংসা শুনে আসছিলাম। শিহরণের এটাই মূল কারণ। স্ত্রী কণা ও দেড় বছরের সন্তান প্রথমকে নিয়ে ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নামলাম ভরদুপুরে। ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে নিতে বেশ সময় লাগল। কারণ বিমানবন্দরে ছিল পর্যটকের উপচে পড়া ভিড়। পর্যটকের এই জোয়ার দেখে নিশ্চিত হলাম, আসলেই এই দেশে দেখার মতো কিছু আছে। যা-ই হোক, বিমানবন্দর থেকে হোটেলের উদ্দেশে রওনা হলাম। তবে শুরুতেই একটা ভুল হয়ে গেল। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পথে চার নেপালি ইশারায় তাদের কাছে যেতে বললেন। জানালেন, ট্যাক্সি নিতে হলে তাদের কাছ থেকে টিকিট কাটতে হবে। সরকারিভাবেই পর্যটকদের জন্য নাকি সেখানে টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হোটেল ‘মহারাজা’ যাব বলাতে আমাদের কাছ থেকে ৪০০ নেপালি রুপি নিয়ে একটি ট্যাক্সির টিকিট দেওয়া হলো। পরে দেখলাম মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরত্বে ‘মহারাজা’ হোটেল। আগে থেকে ধারণা না থাকায় চার গুণ ভাড়ার টাকা চলে গেল পকেট থেকে।
হোটেল বুকিং করা ছিল না।
ট্যাক্সিচালকের পরামর্শমতো মহারাজায় না গিয়ে কাঠমান্ডুর দিল্লিবাজার রোডের প্যানসন ভাসানা হোটেলে উঠলাম। হোটেলের অন্যতম স্বত্বাধিকারী রবিন, অভ্যর্থনাকারী রোজির আতিথেয়তায় আমরা রীতিমতো মুগ্ধ। শূন্য পেটটা যেন ভরে গেল। প্রথম দিনটা হোটেলেই কাটালাম। নেপালে আট দিন থাকব জেনে রবিন আমাকে প্যাকেজের অফার দিল। আট দিনে থাকা, খাওয়া, আকর্ষণীয় জায়গা ঘুরিয়ে দেখানো, সবকিছুর জন্য চাইল ৪০০ ডলার। রাজি হয়ে চুক্তি করলাম। যাঁরা নেপালে যেতে চান, তাঁরা এ ধরনের চুক্তি করতে যাবেন না। কারণটা বলছি। প্যাকেজের চুক্তি করলে আপনি ওই হোটেলের বাইরে খেতে যেতে পারবেন না। গেলে বাড়তি পয়সা দিয়ে খেতে হবে। প্রতি বেলায় একই হোটেলের রেস্তোঁরায় খেয়ে একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল আমাদের। চুক্তি না করলে আমরা ১০০ থেকে ১২০ ডলার বাঁচাতে পারতাম। বিভিন্ন রেস্তোঁরায় খাবারের স্বাদ নিতে পারতাম।
দ্বিতীয় দিন সকালে হোটেল থেকে দেওয়া গাড়িতে রওনা হলাম পাতান (প্রাচীন রাজা আর তাঁদের স্বজনদের আবাসস্থল), স্তুপা টেম্পল, মাঙ্কি টেম্পল দেখতে। স্তুপা মন্দির ঘিরে গড়ে উঠেছে কয়েক শ দোকান। পাতানের আশপাশেও একই চিত্র। প্রাচীন রাজাদের বসবাসের জায়গাটি বহু যত্ন করে সংরক্ষণ করেছে তারা। দু-তিন শ নেপালি রুপি দিয়ে পাতান দেখছে শত শত পর্যটক। সবচেয়ে বড় কথা, নেপালিদের যা আছে, তা অতিথিপরায়ণতার সঙ্গে উপস্থাপনের সব ব্যবস্থাই করে রেখেছে তারা। সে কারণে নেপালে ঢুকলে নিজেকে মেহমান হিসেবে সম্মানিত বলে মনে হয়।
তৃতীয় দিন আমরা পোখারার উদ্দেশে রওনা হলাম। নেপালের সবচেয়ে আকর্ষণীয় নগরী পোখারা রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে। সুউচ্চ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আঁকাবাঁকা পথে পোখারা যাওয়ার ্নৃতি কখনোই ভোলার নয়। ওপরের দিকে তাকালে পাহাড় আর পাহাড়, নিচে তাকালে গভীর খাদ। ছয় ঘণ্টার যাত্রাপথে ভয়টাই যেন অন্য রকম সুখানুভূতির। পোখারার ট্যুরিস্ট বাসস্টেশনে পৌঁছামাত্রই আইসল্যান্ড গেস্টহাউসের (রবিনের প্যাকেজের আওতায়) বিষ্ণু আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। প্যাকেজের কারণে পোখারাতেও আমরা ছিলাম পরাধীন। বাইরের সব চোখধাঁধানো রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে পারিনি। কারণ গেস্টহাউসেই খাবার তৈরি থাকবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। এখানকার রাস্তায় নেপালিদের চেয়ে পর্যটকের সংখ্যাই বেশি। এর সৌন্দর্য সিঙ্গাপুরের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। লেক দেখতে গিয়ে আমরা হতবাক। সাধারণ একটা লেককে এমন করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে, যেন চোখের সামনে ভিউকার্ড তুলে ধরেছে কেউ। প্রথমকে নিয়ে ভোর সাড়ে চারটায় সূর্যোদয় দেখতে বের হই। সরু রাস্তা বেয়ে এত ভোরে অন্নপূর্ণা (তুষারাবৃত সুউচ্চ পর্বত) দেখতে যাওয়ার কথা মনে হলে এখন গা শিউরে ওঠে।
আরেকটা কথা, নেপালে কেনাকাটা করতে গেলে দাম শুনে ভড়কে যাবেন না। পর্যটকদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো বাগিয়ে নিতে তারা অনেক বাড়িয়ে দাম বলে। দরদাম করে অর্ধেকেরও কমে কেনা সম্ভব।
নেপালে নিরাপত্তার ব্যাপারে একেবারেই চিন্তা করতে হবে না। নেপালিরা খুবই আন্তরিক ও সাদামনের মানুষ। যে-কেউ বছরের বিনোদন ছুটিটা নেপালে কাটিয়ে আসতে পারেন। পোখারা থেকে কাঠমান্ডু ফেরার সময় খুব খারাপ লাগছিল। পোখারার স্মৃতি চোখে ভেসে উঠলে মনে হয়, এখনই আবার ছুটে যাই।
নেপালে বাংলাদেশ বিমানে যাওয়া-আসায় জনপ্রতি টিকিট ১৪ হাজার ৩০০। শিশুর বয়স এক বছর ১১ মাসের মধ্যে হলে তার জন্য লাগবে ২৫ শতাংশ ভাড়া। আকাশপথে না গিয়ে সড়কপথে গেলে অনেক কম বাজেটে নেপাল ঘুরে আসা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে যাত্রাপথের ধকলটা কাটাতে সময় লাগবে বৈকি।