মুসলিম আইনে তালাক ও বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়ম কানুন

5156_1298_8124.
ইসলাম ধর্মে তালাক হল আনুষ্ঠানিক বিবাহ বিচ্ছেদ। এটি স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের স্বীকৃত অধিকার। যখন সংসারে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, পরস্পর মিলে মিশে শান্তিপূর্ণ উপায়ে জীবন যাপন করা একেবারেই অসম্ভব কিংবা যখন পারস্পারিক সম্পর্ক তিক্ত হয়ে পড়ে তখন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো যেতে পারে। তালাক হচ্ছে নিরুপায়ের উপায়। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে বিরোধ দেখা দেয় তখনই বিবাহ বিচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে ইসলামে।
.
স্বামী ও স্ত্রী স্বেচ্ছায় বা আদালতের আশ্রয় নিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারে। তালাক মৌখিকভাবে বা লিখিতভাবে যেকোন প্রকারে দেওয়া যায়। মৌখিক তালাকের লিখিত দলিল হচ্ছে তালাকনামা।
.
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে, সে যেকোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর দ্রুত ইউনিয়ন পরিষদ বা মিউনিসিপ্যালিটি বা সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে লিখিতভাবে নোটিশ দিবে এবং স্ত্রীকেও নোটিশের ১টি কপি প্রদান করবে। এতে স্বামীকে তালাকের কারণ দেখাতে হয় না। কোনো ব্যক্তি যদি এভাবে নোটিশ না দেয় তাহলে সে ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। আবার চেয়ারম্যান ও স্ত্রীকে নোটিশ না পাঠালে স্বামী শাস্তি পাবে ঠিকই কিন্তু তালাক কার্যকরী করা বাতিল হবে না।
.
যাহোক, চেয়ারম্যান বা মেয়র নোটিশ গ্রহণ করার পর হতে তালাক কার্যকর করতে ৯০ দিন অপেক্ষা করতে হয়। যখন শুধু মুখে তালাক দেওয়া হয় তখন থেকে ৯০ দিন গণনা শুরু করা যাবে না। নোটিশ পাবার ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে উভয়পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সালিশী পরিষদ গঠন করবেন। এই সালিশি পরিষদ পুনর্মিলনীর জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বিষয়টি যদি সমাধানযোগ্য হয় তবে তার সমাধান করতে হবে। চেয়ারম্যানকে নোটিশ প্রদানের কারণ এটাই। কারণ স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষের মধ্যে আপোষ মিমাংসা করার চেষ্টা করা ছাড়া চেয়ারম্যানের আর কোন দ্বায়িত্ব নেই। তাই তালাক কার্যকর বা অকার্যকর কোনটাই করার এখতিয়ার চেয়ারম্যানের নেই। এরমধ্যে সালিশি পরিষদ উভয় পক্ষকে এই ৯০ দিনের মধ্যে প্রতি ৩০ দিনে ১টি করে মোট ৩টি নোটিশ পাঠাবে। ৯০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগে তালাক প্রত্যাহার করা যাবে। আর যদি তালাক প্রত্যাহার করা না হয় তাহলে ৯০ দিন পর তা কার্যকর হয়ে যাবে। এই সময়টা এজন্যই রাখা হয়েছে যাতে করে স্বামী-স্ত্রী উভয়পক্ষই ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু ভেবেচিন্তে, পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পোঁছতে ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
.
তালাক নোটিশ দেয়ার পরবর্তী ৯০ দিন পর্যন্ত পক্ষগণের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আছে বলে ধরে নিতে হবে। তাই তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী তার স্বামী থেকে এই ৯০ দিনের জন্য অর্থাৎ ইদ্দতকালীন ভরণপোষণ পাবে এবং অনত্র বিয়ে করতে পারবে না। বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে তার নগদ ও বাকী দেনমোহরও তিনি দাবি করতে পারেন। ইদ্দত পালনকালে স্ত্রী তাঁর গর্ভের সন্তানের জন্যও স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু স্ত্রী স্বামীর সম্পত্তির কোন উত্তরাধিকারী হবে না। গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকরী হবে না। সন্তানের বৈধতা বা পিতৃত্ব নির্ধারণের জন্যই এই নিয়ম। তাই তালাক ঘোষণার সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী হয় তাহলে তালাকের নোটিশ দেয়ার ৯০ দিন পর অথবা স্ত্রীর গর্ভাবস্থার সময়কাল, যে সময়কালটা দীর্ঘতর হবে বা যে সময়কালটা পরে শেষ হবে, সেই সময়কালটা অতিবাহিত হলে তখনই তালাক কার্যকর হবে। আবার স্বামী কোন দেনমোহর পরিশোধ করতে না পারলে স্ত্রী এজন্যও তালাক দেয়ার অধিকার রাখে। দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের জন্য স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামী মামলা করলেও স্ত্রী তার তালাক প্রদানের ক্ষমতা হারাবে না। বিবাহবিচ্ছেদ হলে ছেলে সন্তান ৭ বছর পর্যন্ত ও মেয়ে সন্তান বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে।
.
স্ত্রী তখনই তালাক দিতে পারবে, যদি বিয়ের সময় এর লিখিত অনুমতি দেওয়া হয়। মুসলিম আইনে স্ত্রীর তালাকের এই অধিকারকে তালাকে তৌফিজ বলা হয়। বিয়ের কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে লেখা থাকে, স্ত্রীকে স্বামী তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করেছে কি না এবং করলে কী কী শর্তে।
.
যদি কাবিননামায় স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ক্ষমতা দেয়া না থাকে, সেক্ষেত্রে স্ত্রী আদালতের ডিক্রি পাওয়ার মাধ্যমে তালাক দিতে পারবে। ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী, স্ত্রী নিচের ৯টি কারণের যে কোন এক বা একাধিক কারণে আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের দাবি করতে পারবে :
(১) ৪ বছরের অধিক সময় স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে; (২) ২ বছর যাবত স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে স্বামী ব্যর্থ হলে; (৩) স্বামী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত স্ত্রী গ্রহণ করলে; (৪) ৭ বছর বা তার বেশি সময় স্বামী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে; (৫) ৩ বছর ধরে কোনো যুক্তি-সঙ্গত কারণ ছাড়া স্বামী তাঁর দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে; (৬) স্বামী বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করার সময় পর্যন্ত বহাল থাকলে; (৭) ২ বছর ধরে স্বামী পাগল থাকলে অথবা মারাত্বক যৌনব্যধিতে আক্রান্ত থাকলে; (৮) নাবালিকা অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে থাকলে সাবালিকা (১৮ বছর পূর্ণ) হওয়ার আগে স্ত্রী যদি তা অস্বীকার করে। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকলে এরকম মামলা দায়ের করা যাবে না। (৯) নিম্নলিখিত যে কোন কারণে :
(ক) স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করলে। স্ত্রীকে অভ্যাসগত কারণে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করে তাঁর জীবন দুর্বিষহ করে তুললে; (খ) অন্য নারীর সঙ্গে স্বামী অবৈধ মেলামেশা করলে কিংবা নৈতিকতা-বর্জিত জীবন যাপন করলে; (গ) নৈতিকতাবিরোধী জীবনযাপনের জন্য স্ত্রীকে বাধ্য করার চেষ্টা করলে; (ঘ) স্ত্রীর সম্পত্তি হস্তান্তর করে দিলে বা সম্পত্তিতে বৈধ অধিকার প্রয়োগ থেকে তাকে বাধা দিলে; (ঙ) স্ত্রীকে তার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে বাধা দিলে; (চ) যদি স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকে, তবে পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের সাথে সমান ব্যবহার করতে না পারলে। এই কারণগুলোর ভিত্তিতে মামলা দায়ের করতে হলে স্ত্রীর কাছে সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে হবে। এই ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব স্ত্রীর। প্রমাণিত হলে স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদের পক্ষে আদালতের ডিক্রি পেতে পারেন।
.
স্ত্রী স্বামীকে অর্থ বা সম্পত্তি প্রদানের বিনিময়ে তালাক দিতে রাজী করাতে পারেন। সেক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীকে মোহরানার অংশ মাফ করে দিতে পারে। পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী, তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহবিচ্ছেদ হলে তালাকপ্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রী আবার বিয়ে করতে চাইলে নতুন করে বিয়ে করতে পারবে। এজন্য মধ্যবর্তী বা হিল্লা বিয়ের প্রয়োজন নেই। হিল্লা বিয়ে আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে স্ত্রীর পিরিয়ড চলাকালীন স্বামী একাধারে ৩ বার তালাক উচ্চারণ করলে তখন এমন তালাক অপ্রত্যাহারযোগ্য বলে গণ্য হয়।
.
২০০৮ সালে এক জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশে পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যেই তালাক দেয়ার প্রবণতা বেশি। যাহোক, তালাক নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। যে এলাকায় তালাক কার্যকর করা হয়েছে সেই এলাকার নিকাহ রেজিস্ট্রারকে দিয়ে তালাক নিবন্ধন করাতে হবে। যে কোন ধরণের তালাক রেজিষ্টেশনের ক্ষেত্রে নিকাহ রেজিষ্ট্রার বা কাজী সাহেবকে দুইশত টাকা ফি প্রদান করে তালাক রেজিষ্ট্রি করা যাবে।
-সংগ্রহীত
নবীনতর পূর্বতন